প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ৪:৫০:৩৬
সরকারি ঘোষণায় ‘শিশুশিক্ষা বাধ্যতামূলক’, বাস্তবে শিশু শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে লাখো শিক্ষার্থী
নারায়ণগঞ্জ, রংপুর ও খুলনা থেকে | মে ২০২৫
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি টেক্সটাইল কারখানায় সকাল ৯টা। শব্দে ভরে আছে চারদিক, ঘাম ঝরছে শিশুর হাতে। ১১ বছরের মাহিন কাজ করছে বোতাম লাগানোর লাইনে। তার মুখে ক্লান্তি, চোখে ঘুম। প্রশ্ন করলে জানায়, “স্কুলে যাইতাম, বই ভালো লাগত। কিন্তু আম্মু বলে কাজে না গেলে খাবার হবে না।” সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। অথচ বাস্তবে লক্ষ শিশুর জন্য শিক্ষা নয়, জীবিকার লড়াইটাই হয়ে উঠেছে মুখ্য। ‘উপবৃত্তি’, ‘স্কুলে ফিরিয়ে আনা কর্মসূচি’, ‘শিশুশ্রম নিরোধ আইন’ সবকিছুই যেন কেবল কাগজে।
UNICEF ও ILO এর তথ্য: ভয়াবহ বাস্তবতা
জাতিসংঘের শিশু তহবিল UNICEF এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর যৌথ ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩১ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত, যাদের মধ্যে প্রায় ১১ লাখ শিশু ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপযুক্ত। BANBEIS-এর তথ্য মতে, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখে, যার অধিকাংশই পরবর্তীতে শ্রমে যুক্ত হয়েছে।
কারখানায় শিশুরা, স্কুল ফাঁকা: রংপুর শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি ইটভাটায় দেখা যায়, ৯ বছর বয়সী বাচ্চারা কাদামাটি টেনে নিচ্ছে। একজন শ্রমিক মা বলেন, “ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারি না। দিনে যে ২০০-২৫০ টাকা কামায়, ওইটা না হলে পেট চলবে না।” খুলনার দৌলতপুরে একটি গ্লাস ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে অন্তত ৩০ জন শিশু, যাদের কেউই স্কুলে যাচ্ছে না। স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান “শিশুদের নাম ভর্তি আছে, কিন্তু তারা আসে না। উপবৃত্তি বা উৎসাহ যতই থাকুক, পেটের দায় আগে।”
উপবৃত্তি পেলেও স্কুলে আসছে না কেন?
অনেক এলাকায় দেখা যাচ্ছে শিশু উপবৃত্তির জন্য স্কুলে নাম লেখায়, কিন্তু মাসখানেক পরই আবার কাজে চলে যায়। পটুয়াখালী সদরের এক প্রধান শিক্ষক বলেন, “অভিভাবকেরা শুধু উপবৃত্তি চায়, ক্লাসে পাঠাতে আগ্রহী না। তাই টাকা এলেই চলে আসে, তারপর আর দেখা যায় না।” সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় গত বছরের তুলনায় ২০২৫ সালে স্কুল উপস্থিতি কমেছে ৮.২%, যদিও উপবৃত্তি কর্মসূচি চলমান রয়েছে। শিশুশ্রম বিষয়ে কাজ করা এনজিও 'মুক্তি চাইল্ড রাইটস'-এর পরিচালক আমিনুল হক বলেন, “শিশুশ্রম বাড়ছে, কারণ পরিবারগুলো জীবিকা সংকটে। শিক্ষা ও শিশুশ্রম এখন টানাটানির দুই প্রান্তে। শুধু আইনি বাধা নয়, দরকার সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা।” তিনি আরও বলেন, “একটা শিশুকে ক্লাসরুমে রাখতে চাইলে তিনটি জিনিস নিশ্চিত করতে হবে পুষ্টি, পোশাক ও নিরাপদ পরিবেশ।”
আইনি কাঠামো: কতটা কার্যকর?
করণীয় ও সুপারিশ
একটি জাতি তখনই টিকে থাকে যখন তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষিত, সচেতন ও স্বপ্নবান। কিন্তু যদি সেই শিশুরা স্কুলের বদলে শ্রমের যন্ত্রে বন্দি হয়ে পড়ে, তাহলে তা শুধুই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয় জাতীয় উন্নয়নের শিকড় কেটে ফেলার নামান্তর। শিক্ষা যদি অধিকার হয়, তবে তার বাস্তবায়ন শুধু বইয়ে নয় মাঠে, ঘরে, কারখানায় সর্বত্র নিশ্চিত করতে হবে।