ন্যায় দেরিতে হলেও আসে” বিচারকের মন্তব্য ভাইরাল।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১২:২১:৩৪
পটভূমি: আগুনে দগ্ধ এক প্রতিবাদের নাম নুসরাত
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এর কয়েক দিন আগেই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দিয়ে থানায় গিয়েছিলেন নুসরাত। থানায় অভিযোগ নিতে গড়িমসি, ভিডিও করে তা ফেসবুকে ছড়ানো সবই ছিল পরিকল্পনার অংশ।
নুসরাত ছিল সাহসী; কিন্তু সে সাহসকেই শেষ করে দিতে চেয়েছিল সমাজের অসুরেরা।
প্রয়োগিত আইনসমূহ:
দণ্ডবিধি ৩০২ (হত্যা)
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ (ভিডিও ভাইরাল সংক্রান্ত)
আদালতের রায়: ন্যায়বিচারে উজ্জ্বল একটি সকাল
২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর, ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।
বিচারকের মন্তব্য:“ন্যায় দেরিতে হলেও আসে। আজ এই সমাজের কাছে আমরা বলছি—সাহস হারায়ো না। আইনের হাত অনেক লম্বা।”
রায়ে কী বলেছে আদালত?
হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত
পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা ছিল দায়িত্বহীন
রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ উপস্থাপনে সাফল্য পেয়েছে
নুসরাতকে হত্যার আগে সামাজিকভাবে হেয় করার উদ্দেশ্যে ভিডিও ভাইরাল করেছিল পুলিশ সদস্য ও অন্যরা
আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য:
পিপি অ্যাডভোকেট হাফেজ আহম্মদ: “নুসরাতের পক্ষে গোটা দেশ ছিল। তবে সামাজিক চাপ না থাকলে হয়তো এত দ্রুত রায় আসত না।”
তদন্ত কর্মকর্তা মো. শাহ আলম (পিবিআই):“প্রমাণের পাহাড় ছিল। কিন্তু সমাজের চোখে চোখ রেখে কাজ করতে হয়েছে।”
সামাজিক চাপেই কি দ্রুত বিচার? দ্বিধায় জনমত
নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সোশ্যাল মিডিয়া, মিছিল, টকশো, ছাত্র আন্দোলন সবই মিলেই বিচারকে ত্বরান্বিত করেছে। মনোবিজ্ঞানী ডা. ইফতেখার হোসেনের মতে:
“এই ঘটনায় সমাজ শিখেছে দুর্বল বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণচাপ যদি গঠনমূলক হয়, তবে তা ন্যায়ের পক্ষেই যায়।” কিন্তু প্রশ্ন থাকছেই যে সকল মামলায় মিডিয়ার আলো পড়ে না, সেগুলোর ন্যায়বিচার কতোটা নিশ্চিত?
বাস্তব কেস স্টাডি: এক সাহসী কণ্ঠস্বর তামান্না আক্তার
নুসরাত হত্যার পর সিলেটের এক মাদরাসা ছাত্রী তামান্না একইভাবে অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুললেও, তার মামলা এখনো বিচারাধীন।
তামান্নার পরিবার জানায়:“আমরা ভাবছিলাম, নুসরাতের মতোই ন্যায় পাবো। কিন্তু তিন বছরেও চার্জশিট হয়নি।”
এই ঘটনাই দেখিয়ে দেয়, সব ‘নুসরাত’রা সমান আওয়াজ পায় না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তাল প্রতিক্রিয়া:
“এই রায়ই আদর্শ হওয়া উচিত সব ধর্ষণ-হত্যা মামলায়!”
“ফাঁসিই প্রাপ্য ছিল বিচারককে কুর্নিশ।”
“আশা করি আর কোনো নুসরাত হবে না।”
কিন্তু একইসঙ্গে প্রশ্নও ঘুরে ফিরে আসছে “মিডিয়ার ক্যামেরা না থাকলে কি বিচার হতো?”
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: নুসরাত আমাদের কী শেখায়?
সাহসী হলে আইন পাশে থাকে, তবে সমাজের চাপ থাকলে সেটা বাস্তবে দেখা যায়
একজন নারী যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—এক দল নির্যাতককে রক্ষা করে, আরেক দল ন্যায় চায়
তরুণ সমাজের উচিত, ভয় নয় বরং সত্য বলায় বিশ্বাস রাখা
এক নুসরাত ন্যায়ের জন্য নয়, সমাজ বদলের প্রতীক
নুসরাতের মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছে। কিন্তু তার ন্যায়বিচার আমাদের শিখিয়েছে—আইন শুধু কাগজে নয়, সাহসে কাজ করে।
তবে সমাজের প্রতিটি মেয়ে নুসরাতের মতো সাহস পাবে না, যদি আমরা তাদের পাশে না দাঁড়াই।
ন্যায় তখনই পূর্ণ হয়, যখন তা কেবল আলোচিত ঘটনায় নয়—নীরব যন্ত্রণার প্রতিও সমানভাবে কার্যকর হয়।