চীনকে পেছনে ফেলেই রপ্তানি প্রবৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান, টেকসই শিল্প ও শ্রমিক দক্ষতায় বড় ভূমিকা
প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১০:৫০:৪২
বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীন শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও রফতানি নির্ভরতার দিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে অগ্রগামী। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ৩৮.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে, যা বিশ্বের মোট বাজারের ৬.৯০ শতাংশ। এ খাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, চীনের পরেই, আর ভিয়েতনামের আগে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (বিএই)-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্ব পোশাক বাজারের মোট মূল্য ছিল ৫৫৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চীন এককভাবে ১৬৫.২৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে ২৯.৬৪ শতাংশ বাজার দখলে রাখে। তবে চীন এ খাত থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে অন্যান্য খাতে মনোযোগ দিচ্ছে, ফলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের রফতানির ৮৬.২০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যা দেশের অর্থনীতিকে এই একক খাতের ওপর অধিক নির্ভরশীল করে তুলেছে। তুলনামূলকভাবে চীনের রফতানির মাত্র ৪.৩০ শতাংশই এ খাত থেকে আসে। অন্যদিকে কম্বোডিয়া (৩৬.৭০%), পাকিস্তান (২৬.৮০%), ভিয়েতনাম (৭.৬০%), ভারত (২.২০%) ও ইন্দোনেশিয়া (২.৩০%) বিভিন্ন মাত্রায় এ খাতে নির্ভরশীল।
রফতানির দিক থেকে ভিয়েতনাম ৩৩.৯৪ বিলিয়ন ডলার (৬.০৯ শতাংশ), আর ভারত ১৬.৩৬ বিলিয়ন ডলার (২.৯৪ শতাংশ) রফতানি করে। তবে রফতানি নির্ভরতায় বাংলাদেশের পরে অবস্থানে আছে কম্বোডিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ‘পাল্টা শুল্কনীতি’র আওতায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো শুল্ক চাপে পড়লেও বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে চীনের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর যেখানে সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ওপর গড় শুল্কহার ৩৫.৫ থেকে ৩৬.৫ শতাংশ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহার করা পোশাকের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কছাড় বাংলাদেশের জন্য কিছুটা স্বস্তির। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ শুল্কহার ৩৪ শতাংশ, ভারতে ৩৩.৫ থেকে ৪০.৫ শতাংশ, আর ভিয়েতনামে ৩৩.৫ থেকে ৪১ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে এই দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উচ্চমানের পণ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে ভালো অবস্থানে থাকায় সুবিধা পাচ্ছে। অনেক মার্কিন ব্র্যান্ড সরাসরি ভারত থেকে আমদানি করে, আবার ভিয়েতনামকে চীনের বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে। চীনের বিপুল রফতানি সত্ত্বেও ২০২৪ সালে ১৬৫ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ফলে দেশটি সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাপে পড়েছে। ৪৬ থেকে ৫৫ শতাংশ শুল্কহার মার্কিন ক্রেতাদের চীনের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই ধীর প্রত্যাহারের সুযোগে বাংলাদেশ অনন্য সম্ভাবনার মুখোমুখি। শ্রম ব্যয় কম, উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি হওয়ায় অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। তবে এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, প্রযুক্তিনির্ভরতা, উচ্চমূল্যের পণ্য, নিজস্ব ব্র্যান্ড এবং ফ্যাশন ইনোভেশন। বিশ্লেষকরা আরও বলেন, চীনের অর্থনীতি বহুমুখী হলেও তারা এখনও পোশাক খাতকে সরকারি প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ওপর এ খাতের একচেটিয়া নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ। বিকল্প খাত যেমন টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, আইটি ও হস্তশিল্পে বৈচিত্র্য আনা জরুরি।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আমাদের রফতানি আয়ের মূল ভিত্তি। চীন যেহেতু ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, আমাদের এখন সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাজারে আরও বড় অংশ নিতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “এখন দরকার একটি সমন্বিত রফতানি কৌশল, যাতে পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও বৈচিত্র্য আনা যায়।”
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন গর্বের, তেমনি তা একটি কঠিন বাস্তবতার প্রতিফলন। এক খাতনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে পরিকল্পিত শিল্পনীতি, প্রযুক্তি ব্যবহার, বাজার বৈচিত্র্য এবং শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারলে, তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।