প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ৪:৪৫:১৪
একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। পরিচয় এখানেই শেষ না, তিনি একজন গুণী কথাসাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ। অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে তার ঝুলিতে। যার মধ্যে অন্যতম একাত্তরের দিনগুলি। জাহানারা ইমামের মতো অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির বইও বাংলা একাডেমি সংগ্রহশালায় ছিল। সেসব বই কেজি দরে বিক্রি নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এরপর বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়ে বাংলা একাডেমি নিজেদের অবস্থান জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৪ সালে ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত কমিটি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘পরিত্যক্ত হিসেবে শনাক্ত’ হওয়া কিছু বই সরানো হয়েছে। তবে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর ২০১৪ সালের কমিটির সিদ্ধান্ত কেন বাস্তবায়িত হলো সে ব্যাপারে বিবৃতিতে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
জাহানারা ইমামের বই বিক্রি
পুরোনো বই বিক্রির ফেসবুক পেজ 'পুস্তক জোন' গত ২২ সেপ্টেম্বর পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত জর্জ বার্নাড শ–এর 'প্লেস আনপ্লিজেন্ট' বইটি বিক্রির পোস্ট দেয়। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর তারা 'অচেনা দিগন্ত' নামের বই বিক্রির পোস্ট দেয়। এসব বইয়ের ভেতরে বাংলা একাডেমির সিল এবং জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহের সিল ছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার অন্তত ২০টি বাংলা ও ইংরেজি বই বাংলা একাডেমি থেকে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। জাহানারা ইমামের বই বিক্রির খবর ছড়িয়ে পরার পর থেকেই চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই বলছে যে সংগ্রহশালা তার স্মৃতিটুকু যত্নে বেঁচে রাখার চেষ্টা করবে। তারাই কিনা ওজন দিয়ে বিক্রি করছে।
কেউ লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমির সংগ্রহের বই এখন ফুটপাতে।’ কেউবা লিখছেন, ‘এভাবে কি দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না?’
বইগুলো পেজে গেল কীভাবে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নীলক্ষেতের ফুটপাতে পড়েছিল বাংলা একাডেমির সংগ্রহশালায় থাকা গুণি লেখকদের অনেক বই। সেখান থেকেই পুরোনো বই বিক্রির একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হচ্ছে বইগুলো।
এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নীলক্ষেতসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় এক ট্রাক পুরোনো বই কিনেছেন তারা। বাছাইয়ের সময় দেখতে পায়, কিছু বইয়ে ভেতরে রয়েছে বাংলা একাডেমির সিল, পাশে লেখা ‘জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত সংগ্রহ’। এ ছাড়া ‘দুর্লভ বই’ বিজ্ঞাপন দিয়েছে জাহানারা ইমামের সংগ্রহের ‘পথ বেঁধে দিল’ বইটি বিক্রির।
এই ব্যাপারে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমের সঙ্গে নাগরিক প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা একটি বিবৃতি দিয়েছি। সেটাই আমার বক্তব্য।
বাংলা একাডেমির বিবৃতি কী বলা হয়েছে
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে থেকে জাহানারা ইমামসহ অন্যদের দেওয়া বইগুলো যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই আছে। এ বিষয়ে কোনো নতুন কমিটি গঠিত হয়নি, বা সংগ্রহশালা পুনর্মূল্যায়নের কোনো ঘটনাও ঘটেনি। অন্তত এক দশক ধরে জমা হওয়া পরিত্যক্ত বইগুলোই কেবল বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন যুক্ত হয়েছে কেবল গত বছরের বইমেলায় প্রাপ্ত মানহীন ও পরিত্যক্ত ঘোষিত বইগুলো।
বর্তমান বিতর্কের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হলো, তাহলে এ তালিকায় জাহানারা ইমাম সংগ্রহের বেশ কিছু বই কীভাবে যুক্ত হয়েছে?
২০১৪ সালে ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত কমিটি’ গঠিত হয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ কমিটির প্রথম সভায় উপস্থিত ছিলেন শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, জনাব ফরিদা পারভীন, রেজিনা আক্তার ও মো. মোবারক হোসেন। সভার সিদ্ধান্ত হয় যে গ্রন্থাগার থেকে কিছু বই ছাঁটাই করতে হবে। সে অনুযায়ী কোন কোন বই গ্রন্থাগারে থাকবে না তা নির্ধারণ করেছে কমিটি।
বাংলা একাডেমিতে রক্ষিত তালিকা থেকে দেখা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে জাহানারা ইমামের মোট ৩৫৯টি বই দেওয়া হয়েছিল। বাছাইয়ের পরে অধিকাংশ বই সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট হয়। ‘বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে সংরক্ষণার্থে গ্রন্থ বাছাই কমিটির বাছাইকৃত গ্রহণযোগ্য বইয়ের তালিকা (জাহানারা ইমাম)’ প্রণয়ন করা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। ওই বইগুলো বাংলা একাডেমির নির্দিষ্ট সেলফে মজুদ আছে। সেখানে বইয়ের সংখ্যা ৩০৮টি। তিনতলার নির্ধারিত স্থানে যে কেউ বইগুলো দেখতে এবং ব্যবহার করতে পারবেন।
জাহানারা ইমামসহ অন্য সংগ্রহের যেসব বই গ্রন্থাগারের জন্য উপযোগী বিবেচিত হয়নি, সেগুলো আলাদা করে আর্কাইভ করা যেত। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা তখনকার দায়িত্বশীলরা কেন করেননি তা এখন অনুমান করা কঠিন। তখন একাডেমি-প্রশাসনের প্রধান পদগুলোতে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই গত হয়েছেন; অন্যরাও এখন আর একাডেমিতে কর্মরত নেই। তখন গ্রন্থাগারের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারাও কেউ নেই। ফলে এই পরিত্যক্ত বইয়ের ভান্ডারে জাহানারা ইমাম সংগ্রহের কোনো বই তো দূরের কথা, কোনো ব্যবহার্য বই থাকতে পারে এমন দূরতম অনুমান করারও বাস্তবতা ছিল না।
বাংলা একাডেমির বর্তমান দায়িত্বরতদের সম্পর্কে বলা যায়, বইগুলো বিক্রির আগে আরেকবার পরীক্ষা করা যেত। কিন্তু বইয়ের সংখ্যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার। তদুপরি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বই এখানে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনাও সংশ্লিষ্ট কারও অভিজ্ঞতায় ছিল না।