প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫২:৪৫
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যারনরা যে যুক্তি সামনে রেখে আপার হাউজ পিআর অর্জনের জন্যে সংস্কার বৃহৎ সমঝোতাটাকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন, কেউ আপনাদের বলে নাই, আমি বলছি — যুক্তিটা ভুয়া।
যুক্তিটা হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলে সংবিধানের বিধি পাল্টানো যায়। সেইটা ঠেকাতে আপার হাউজে নিম্নকক্ষের ভোটের অনুসারে আসন দিতে হবে। এইটার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে কোনো দল ঐতিহাসিকভাবে ৪০% এর উপরে ভোট পায় নাই, তাই পিআর হলে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলেও একটা দল সংবিধান পাল্টাতে পারবে না।
এইটার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখে দুইটা উদাহরণ দেওয়া হয় —
১। বিএনপি নিজের মতো করে তত্ত্বাবধায়কের প্রধান নির্ধারণ করতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স সীমা পাল্টেছিল।
২। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করেছে।
যুক্তিটা হচ্ছে, আপার হাউজে পিআর থাকলে এই দুইটা বিএনপি বা আওয়ামী লীগ করতে পারবে না। তাই, আগামীতে সংবিধানের এই ধরনের এবিউজ ঠেকাতে আপার হাউজে পিআর লাগবে।
আপার হাউজ পিআরের পক্ষের এই যুক্তিটা ভুয়া, কারণ একই লক্ষ্য আর দুইভাবে অর্জন করা যায়—
১। সংবিধান সংশোধনে গণভোট আবশ্যিক করে। (যেইটা এখন আবার আসবে)
২। নিম্ন কক্ষে সংশোধনের জন্যে ২/৩ বা ২০০ বা ৬৬% নয়, বরং ২৫০টি আসন বা ৮৩% সিট আবশ্যিক করে দিলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সমাধানে না গিয়ে কেন আপার হাউজ পিআরের জন্যে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে রাজনৈতিক ঐক্যমত হবে না এবং পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াই ঝুঁকির মুখে পড়বে। আপার হাউজ পিআরের আরেকটা বড় সমস্যা কেউ বলছে না। এটা সম্পূর্ণ অনির্বাচিত। এটা সিম্পলি বাংলাদেশের এলিটদের প্লেগ্রাউন্ডে পরিণত হবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এই সিটগুলো কোটি কোটি টাকায় বেচবে, যেখানে বাংলাদেশের ওলিগার্করা একটা একটা সিট কিনবে—যেটা হাউজ অফ লর্ডসে পরিণত হবে।
আমি সব সময়ই আপার হাউজে ডাইরেক্ট ইলেকশন ও আমেরিকার মতো মিডটার্ম ইলেকশনের পক্ষপাতি ছিলাম, যেটা অনির্বাচিত আপার হাউজ পিআরের থেকে অনেক বেটার অপশন। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমাকে সেই অবস্থান থেকে বের করে আনছেন এই বলে যে, টেবিলে যত অপশন আছে, সেইগুলোর মধ্যে এইটা সবচেয়ে ভালো আইডিয়া। কিন্তু আমি কখনোই বুঝিনি, টেবিলে আপার হাউজ ডাইরেক্ট ইলেকশন ও মিডটার্ম নাই কেন? তবু আমি গ্রুপ থিংকিং-এর সাথে ছিলাম। এখন সেই খুবই ফল্টি আপার হাউজ, যেটা রাজনৈতিক ব্যারনদের প্ল্যানে একটা এলিটদের প্লেগ্রাউন্ড হবে—সেইটা নিশ্চিত করার জন্যে সংস্কারকে হোস্টেজ করা হয়েছে।
কিন্তু এইটা অর্থবহ কি না?
আমার মতে না। কারণ এনসিপি ও জামায়াতের কোনো ইনসেন্টিভ নাই সমঝোতার পৌঁছানোর যেখানে তারা জানেন, জুলাই চার্টারের মতো অত্যন্ত ফল্টি ডকুমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে রাজনৈতিক কনসেনসাসের উপরে। এই সমঝোতাটাই জুডিশিয়াল রিভিউয়ের বিপরীতে প্রটেকশন। কারণ আইন সব সময়ই রাজনৈতিক সমঝোতা আমলে নেয়—কাগজে যাই থাকুক। আপনি গণভোটের মাধ্যমে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির ম্যান্ডেট দিয়েও সেইটা ঠেকাতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্ট বলবে, বিশেষ আদেশ জারি করে এই গণভোটটাই অবৈধ ছিল, যার ফলে এই কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠনটাই অবৈধ ছিল ।
এইটা তখনই কোর্ট বলতে পারবে না, যখন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সহ অন্যান্য পক্ষের রাজনৈতিক সমঝোতা থাকবে। কিন্তু যেই মুহূর্তে সেই সমঝোতা থাকবে না, কোর্টের জন্যে সব অপশন খোলা থাকবে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও, বিএনপির একগুঁয়েমির মধ্যেও সেই সমঝোতাটা এসেছিল।
জামায়াতের ইনসেন্টিভ নির্বাচন। তারা মুখে যাই বলুক, তারা ঠিকই সাইন করেছে। এই যে সংকট তৈরি হয়েছে, আমি টেকনিক্যালি দেখাতে পারব, উভয় পদ্ধতিতেই আপার হাউজ পিআর অর্জিত হয় না। অপশন ওয়ানে একটা বিল বানাতে হবে — বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সেইটার টেকনিক্যালিটিতে আগামী কয়েক সপ্তাহে একমত হতে পারবে না।
এবং অপশন টু-তেও পার্লামেন্ট যে বিল ড্রাফট করবে, সেটাতেও অনেক ম্যানিপুলেশন সম্ভব। ফলে ক্লিয়ারলি আমরা এখন আপার হাউজ পাওয়ার জন্যে লিম্বোতে পৌঁছেছি। আর ১০০টা অপশনকে প্যাকেজ করে আদেশের উপরে গণভোট করায়, সেইটা দিয়ে জোর করে আপার হাউজ করলে, বিএনপি যদি ২/৩ ভোট পায় তবে সেইটা সে আবার বাতিল করে দিতে পারবে।
এইটা এবসারড যে রিয়াজ ভাই তার কোনো দুঃস্বপ্নে তার এত কেয়ারফুলি কনস্ট্রাক্ট করা সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়াকে এই ভাবে সাবোটাজ করতে পারেন।
লেখক, অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান এর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া।