প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩:৫৫:০১
বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ প্রথমবারের মতো ছাড়িয়েছে ২১ ট্রিলিয়ন (২১ লাখ কোটি) টাকা। দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব আয়ের দুর্বলতা আর উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে বেড়েছে এই ঋণ। সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টার আজ শনিবার এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত অর্থ বিভাগের ঋণ বুলেটিনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জুনের শেষে ঋণের পরিমাণ ২১ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছায়, যা এক বছর আগের ১৮ দশমিক ৮৯ ট্রিলিয়ন টাকার চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট ঋণের ৪৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত পাঁচ বছর ধরে বেড়েই চলছে বৈদেশিক ঋণ। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ২০ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৭ শতাংশ।
বেড়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণও, যা গত অর্থবছরের ১০ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে ১১ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে অভ্যন্তরীণ ঋণ ছিল ৭ দশমিক ২২ ট্রিলিয়ন টাকা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণ অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এগুলো মহামারির পর উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো থেকে পাওয়া বাজেট সহায়তা এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রো রেল ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর জন্য করা ব্যাপক ব্যয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সরকারি ঋণের ধারা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক।’
তিনি বলেন, ‘রাজস্ব সংগ্রহে ধীরগতির কারণে রাজস্ব বাজেটে কার্যত কোনো উদ্বৃত্ত নেই, যার ফলে সরকার উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক— উভয় ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক ঋণ বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হারও এখন বেশি। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণে অনুদানে খুব কম থাকে বা কোনো অনুদান থাকেই না। আর ঋণের বেশির ভাগ কঠিন শর্তের-উচ্চ সুদ, পরিশোধের সময় কম আর স্বল্প সময়ে (গ্রেস পিরিয়ড) অর্থ পরিশোধ শুরু করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ তীব্রভাবে বাড়াচ্ছে।
গত মাসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত, যেখানে সরকারি ও সরকারি-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ ১৩ বছরে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।’
ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে সরকার সুদ হিসেবে এক লাখ ৩২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে, যা এক বছরের ব্যবধানে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
বৈদেশিক ঋণের সুদের অর্থ পরিশোধ ২১ শতাংশ বেড়েছে, আর দেশীয় ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালে সুদের অর্থ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা; ২০২১ সালে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের সুদের অর্থ পরিশোধের পরিমাণ গত বছরে ৪৩ শতাংশ বেড়েছে তার আগের বছরের তুলনায় ।
ঋণ সংক্রান্ত বুলেটিনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও মধ্যম পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘সুরক্ষিত সীমা’র মধ্যে রয়েছে, তবে কিছু অর্থনৈতিক সূচক এখন সতর্কতার সংকেত দিচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদে ঋণ টেকসই রাখার ক্ষেত্রে বুলেটিনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ ঋণ ব্যবস্থাপনা, নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের কঠোর যাচাই, বাস্তবায়ন দক্ষতার উন্নয়ন, রাজস্ব আহরণের ত্বরান্বিত ব্যবস্থা এবং রপ্তানি আয় সম্প্রসারণ ও বৈচিত্র্যকরণের প্রতি আরও গভীর মনোযোগ প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বৈদেশিক ঋণের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে অর্থবছর-২৬-এর জন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ওপর একটি সীমা আরোপ করেছে।
এই সীমার অধীনে বাংলাদেশ এই অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে পারবে, যার মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার এবং প্রথমার্ধে ৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আইএমএফ তার ঋণ কর্মসূচির অধীনে ত্রৈমাসিকভাবে এই ধরনের ঋণ পর্যবেক্ষণ করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই সীমা আইএমএফের সর্বশেষ ঋণ স্থায়িত্ব বিশ্লেষণ (ডিএসএ) অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশকে অর্থবছর-২৩ এবং অর্থবছর-২৪ -এ 'মধ্যম-ঝুঁকিপূর্ণ' দেশ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে।
'নিম্ন ঝুঁকি' থেকে এই অবনমনের কারণ হলো রপ্তানি ও রাজস্বের তুলনায় ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধি।
ডিএসএ অনুসারে, বাংলাদেশের ঋণ-রপ্তানি অনুপাত অর্থবছর-২৪-এ ১৬২ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আইএমএফের আগের অনুমান ১১৬ থেকে ১১৮ শতাংশের চেয়েও অনেক বেশি।
ঋণ পরিশোধ-রাজস্ব অনুপাতও বেড়েছে, যা সরকারের নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ আরও সংকীর্ণ করছে। আইএমএফ জানায়, স্ট্রেস টেস্টে দেখা গেছে, রপ্তানি পরিসংখ্যানে নিম্নমুখী সংশোধনের কারণে এসব অনুপাতগুলি ধারাবাহিকভাবে সীমা অতিক্রম করছে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, আগামী সরকারকে রাজস্ব আহরণে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের মাত্র অর্ধেক। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন শক্তিশালী করতে হবে এবং প্রশাসন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুদহার, ঋণের উৎস, পরিশোধ সময়সূচি এবং ছাড়ের সময়কাল সাবধানে বিবেচনা করতে হবে, যেন নতুন ঋণ কেবল পুরনো ঋণ পরিশোধে ব্যবহার না হয়।এটা হলে আর ঋণের চক্র এ পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে ।
সমন্বিত ঋণ ব্যবস্থাপনা
আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুসরণ করে বাংলাদেশ এখন সরকারি ঋণ তদারকি জোরদার এবং আর্থিক ও পরিচালন ঝুঁকি কমাতে একটি সমন্বিত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় (ডিএমও) প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কারিগরি সহায়তা দেওয়া বহুপক্ষীয় ঋণদাতারা চলতি মাসের শুরুতে অর্থ বিভাগে একটি কর্মশালায় তাদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে।
অর্থ বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের একটি যৌথ কারিগরি সহায়তা মিশন পর্যবেক্ষণ করেছে যে বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনার কাজগুলো বর্তমানে একাধিক সংস্থার মধ্যে বিভক্ত। ফলে সমন্বয়ের ঘাটতি, অসঙ্গত ঋণের তথ্য এবং একটি বিস্তৃত কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অসুবিধা দেখা দিচ্ছে।
এ ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় ও নিরীক্ষিত ঋণ ডাটাবেইসের অনুপস্থিতি এবং আনুষ্ঠানিক নগদ প্রবাহ পূর্বাভাস ব্যবস্থার অভাবকেও তারা চিহ্নিত করেছে। এগুলো কার্যকর ও সাশ্রয়ী সরকারি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মিশনটি প্রস্তাব করে, সরকার ও সরকার-গ্যারান্টিযুক্ত সব ঋণ-সম্পর্কিত কার্যক্রম অর্থ বিভাগের অধীনে একীভূত করা হোক। এর প্রথম ধাপ হিসেবে ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা শাখা পুনর্গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত ডিএমও দেশীয় ঋণ ইস্যু তত্ত্বাবধান করবে, বার্ষিক ঋণগ্রহণ পরিকল্পনা তৈরি করবে, নিলাম ক্যালেন্ডার সমন্বয় করবে, ঋণ পোর্টফোলিও ঝুঁকি মূল্যায়ন করবে এবং বিদ্যমান সিস্টেম ও ডাটাবেজ একত্রিত করে একটি সমন্বিত ঋণ ডাটাবেজ তৈরি করবে।
মিশনটি ঋণ নেওয়ার কর্তৃত্ব, জবাবদিহিতা, প্রতিবেদন দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতার মান নির্ধারণের জন্য একটি স্পষ্ট আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। পেশাদারত্ব নিশ্চিত করার জন্য মিশনটি ডিএমও-তে পুঁজিবাজার, মূল্য নির্ধারণ, নিষ্পত্তি কার্যক্রম এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ কর্মীদের নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
দক্ষ পেশাদারদের ধরে রাখতে সরকারকে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষতিপূরণ এবং ক্যারিয়ার উন্নয়নের পথ চালু করতে হবে।
মধ্যমেয়াদে ডিএমও আরও স্বায়ত্তশাসিত সত্তায় পরিণত হতে পারে যার সম্প্রসারিত কার্যাবলী থাকবে, যার মধ্যে থাকবে আকস্মিক দায়বদ্ধতা তদারকি এবং বিনিয়োগকারী সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা। ডিএমও প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, পর্যায়ক্রমে পুনর্গঠন, আধুনিক আইটি সিস্টেমে বিনিয়োগ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে টেকসই সমন্বয় প্রয়োজন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, একবার কার্যকর হলে একীভূত ডিএমও বাজারের আস্থা বাড়াবে, অর্থায়ন খরচ এবং ঝুঁকি কমাবে এবং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করবে বলেও আশা করা হচ্ছে।