প্রকাশিত : ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ৫:০২:১৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময় থেকে আজ অবধি অ্যাডলফ হিটলারের মৃত্যু ও তার ব্যক্তিগত রহস্য ঘিরে অসংখ্য প্রশ্নে ইতিহাসবিদরা দ্বিধায় ছিলেন। বার্লিনের বাঙ্কারে আত্মহত্যা, দেহ পুড়িয়ে দেওয়া, শত্রুকে প্রমাণ না দিতে সহযোগীদের পদক্ষেপ নেওয়াসহ দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, হিটলারের সবচেয়ে গোপন সত্যগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে। তার মানসিক অবস্থা, শারীরিক সমস্যা, বংশপরিচয় এসব নিয়ে বহু গবেষণা হলেও নিশ্চিত প্রমাণের ঘাটতি ছিল যুগের পর যুগ। তবে তার মৃত্যুর আট দশক পরে সত্য উন্মোচন করল আধুনিক প্রযুক্তি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ৪-এর দুই পর্বের তথ্যচিত্র ‘হিটলারস ডিএনএ: ব্লুপ্রিন্ট অব এ ডিক্টেটর’—এ প্রাচীন ও ফরেনসিক ডিএনএ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টুরি কিংয়ের নেতৃত্বে একটি দল প্রথমবারের মতো দাবি করেছে, তারা হিটলারের প্রকৃত ডিএনএ শনাক্ত করতে পেরেছেন। আর সেই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে কয়েকটি চমকপ্রদ এবং বহু পুরোনো বিতর্ককে নতুনভাবে মূল্যায়নের মতো তথ্য।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলে বার্লিনের বাঙ্কারে হিটলার আত্মহত্যার পর তার নির্দেশমতো দেহে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে ফেলেছিল সহযোগীরা। তাই বলা হতো—নিজের সবচেয়ে গোপন তথ্যগুলোও কবরে নিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু আধুনিক ফরেনসিক প্রযুক্তি সেই ধারণা ভেঙে দিল। হিটলার হয়তো কস্মিনকালেও ভাবেননি যে, তার আত্মাহুতির মাত্র আট বছর পরই ডিএনএর গঠন আবিষ্কৃত হবে। আর আট দশক পরে আধুনিক প্রযুক্তি তার বহু অজানা তথ্য বিশ্বের সামনে টেনে আনবে।
গবেষকরা হিটলারের রক্তযুক্ত কাপড়ের একটি টুকরো থেকে জিনগত নমুনা সংগ্রহ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গ মিউজিয়াম অব হিস্টরি থেকে সংগৃহীত ওই কাপড়ের রক্তের ডিএনএ পরে তার পৈত্রিক সূত্রের এক আত্মীয়ের লালার (নমুনা) সঙ্গে হুবহু মিলেছে। ইতিহাসে এই প্রথম হিটলারের ডিএনএ নিশ্চিত হলো। কাপড়টি মার্কিন সেনাবাহিনী কর্নেল রোজওয়েল পি. রোজেনগ্রেন বার্লিন পতনের পর সংগ্রহ করেছিলেন। সেটি গবেষণার জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করেছেন সংগ্রাহক এরিক এল. ডোর।
তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বে দেখা যায়, ফরেনসিক জেনেটিসিস্টরা সেই বিবর্ণ কাপড় থেকে সূক্ষ্ম এক কণা রক্ত সংগ্রহ করেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় নিশ্চিত করা হয়, নমুনাটি একজন পুরুষ মানুষের। এছাড়াও ১৯৪৫ সালের ঘটনার সঙ্গে বয়সগত মিলও রয়েছে। পরে এই নমুনা মেলানো হয় অস্ট্রিয়ায় এক পুরুষ আত্মীয়ের লালার (নমুনা) সঙ্গে, যা সাংবাদিক জিন-পল মাল্ডার্স ও ইতিহাসবিদ মার্ক ভার্মিরেন সংগ্রহ করেছিলেন। দুটি নমুনাই ‘হুবহু’ মিলেছে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো হিটলারের ডিএনএ নিশ্চিত করা হয়েছে।
ডিএনএ বিশ্লেষণে সবচেয়ে আলোচিত ফল হলো, হিটলারের ডিএনএতে একটি জিনগত ‘ডিলিশন’ রয়েছে। পিআরওপিকে২ নামের যে জিনে এই মিউটেশন পাওয়া গেছে, তা ক্যালম্যান সিনড্রোমের সঙ্গে শক্তভাবে জড়িত। এই অবস্থায় এক বা উভয় অণ্ডকোষ স্বাভাবিকভাবে নেমে না-ও আসতে পারে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ১৯২৩ সালের একটি মেডিকেল রিপোর্টে তার অণ্ডকোষে ত্রুটির যে দাবি ওঠে, নতুন জিনগত তথ্য সেই পুরোনো আলোচনাকে আরও বাস্তবসম্মত করে তুলেছে। অর্থাৎ তার অণ্ডকোষ একটিই ছিল।
কানাডায় বেড়ে ওঠা অধ্যাপক কিং মজা করে বলেন, ব্রিটেনে যুদ্ধকালীন প্রচারণার গান ‘হিটলার হেজ অনলি গট ওয়ান বল’ জনপ্রিয় ছিল। দেশটিতে এমন কেউ নেই যে গানটি শোনেনি। তথ্যচিত্রে গানটির বহুল প্রচারণার সঙ্গে ডিএনএর ফলাফলকে কাকতালীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই দশক ধরে নাৎসি জার্মানি নিয়ে গবেষণা করা ইতিহাসবিদ ড. অ্যালেক্স জে বলেন, ব্রিটিশরা কীভাবে সেই গান তৈরি করেছিল, তা আজও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ডিএনএর ফলাফল দেখাচ্ছে, এতে সত্যের একটি ছায়া হয়তো ছিল। তার মতে, এটি নিছক কাকতালীয়ও হতে পারে। অথবা এ তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, হিটলার ছিলেন নাৎসি শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সবচেয়ে অস্বাভাবিক, কারণ তার বিবাহিত জীবন বা সম্পর্ক অন্যদের মতো ছিল না।
ক্যালম্যান সিনড্রোম টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়া, যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস এবং কিছু ক্ষেত্রে মাইক্রোপেনিসের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তথ্যচিত্রটি দীর্ঘ আলোচনা করেছে হিটলারের নিজের ভাগনির প্রতি তার অস্বাভাবিক আচরণ এবং তার বিছানার চাদরে ‘যৌন কর্মকাণ্ডের অভাব’—এই প্রশ্নগুলো নিয়ে।
গবেষকরা হিটলারের জিনগত ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য পলিজেনিক স্কোরও গণনা করেছেন। তাতে দেখা যায়, অসামাজিক আচরণ বা মানসিক রোগ–সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের জিনগত প্রবণতায় তিনি শীর্ষ ১০ শতাংশের মধ্যে ছিলেন। অটিজম–সম্পর্কিত স্কোর তাকে শীর্ষ এক শতাংশে এবং এডিএইচডি ঝুঁকিতে সাধারণের উপরে রেখেছে। তবে বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনো জিনই কারও আচরণ বা সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে না; এসব কেবল সম্ভাবনার ক্ষুদ্র অংশমাত্র।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান হলো—হিটলারের ইহুদি বংশধর হওয়ার বহু পুরোনো গুজব বিজ্ঞানসম্মতভাবে খণ্ডিত হয়েছে। তার দাদি কোনো ইহুদি পরিবারের সদস্যদ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন—এমন দাবি বহু দশক ধরে প্রচলিত ছিল। এমনকি ২০২২ সালে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভও তা পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু ডিএনএ বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, পিতৃ-বংশের লাইনে এর কোনো প্রমাণ নেই। বরং জেনেটিক মিল গুজবটিকে নিশ্চিতভাবেই বাতিল করে দিয়েছে।
হিটলারের মানসিক অবস্থা নিয়ে গবেষণা নতুন নয়। আইরিশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল ফিটজেরাল্ড জানান, প্রায় দুই দশক আগে তার অনুসন্ধান তাকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে গিয়েছিল যে, হিটলারের বিভিন্ন ধরনের স্নায়ু–বিকাশজনিত সমস্যা ছিল। তথ্যচিত্রে দেখা যায়, এডিএইচডি–এর ক্ষেত্রে হিটলারের জেনেটিক স্কোর ছিল গড়ের তুলনায় বেশি। স্কুলের রিপোর্টসহ পুরোনো নথিপত্র এই ধারণার পক্ষে কিছু প্রমাণও দেয়। আরও নাটকীয়ভাবে তথ্যচিত্র নির্মাতারা হিটলারের শৈশবকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্মিত ভিডিওর মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, যা এই বিতর্কিত বিশ্লেষণকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে।
দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হয়েছে, হিটলারের সিজোফ্রেনিয়া ঝুঁকির পলিজেনিক স্কোরও শীর্ষ এক শতাংশে। যদিও গবেষকেরা স্পষ্ট বলেন, এটি রোগ নির্ণয় নয়, কারণ হিটলারের আচরণে সিজোফ্রেনিয়ার ক্লিনিক্যাল লক্ষণ দেখা যায়নি।
তবে তথ্যচিত্রের কিছু অংশে গবেষকরা নিজেরাই দ্বিধাগ্রস্ত। উদাহরণ হিসেবে, হিটলারের দ্বিতীয় চাচাতো বোন অ্যালোইসিয়া ভেইট, যিনি সিজোফ্রেনিয়ার কারণে নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে মারা যান, তার প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছে, পরিবারে রোগটি চলতে পারে। অধ্যাপক কিং এ ব্যাপারে সতর্কতার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দ্বিতীয় চাচাতো ভাই–বোনকে বাদ দিলে জেনেটিক সম্পর্ক খুব দুর্বল, তাই এর ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
তবে গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, হিটলারের ব্যক্তিত্ব বোঝার চাবিকাঠি শুধু জিন নয়; তার শৈশবও। ১৮ বছর হওয়ার আগেই পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চারজন এবং বাবা-মাকে হারান তিনি। ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স জের মতে, এই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলো তার চরিত্র গঠনে বড় অবদান রেখেছে।
তথ্যচিত্রের শেষে বলা হয়েছে, জেনেটিক তথ্য দিয়ে হিটলারের চিন্তা বা অপরাধ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বিপজ্জনক। কারণ অ্যাডলফ হিটলারকে ‘হিটলার’ বানিয়েছে রাজনীতি, ক্ষমতা, সহযোগী বা আশপাশের মানুষ এবং ইতিহাসের নির্মম বাঁক। অবশ্য অধ্যাপক কিং কড়া ভাষায় মন্তব্য করেন, ইউজেনিক্সে বিশ্বাসী হিটলার যদি নিজের ডিএনএ–ই জানতেন, ‘তাহলে নিজেই নিজেকে গ্যাস চেম্বারে পাঠাতেন।’
তথ্যসূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ