নারীদের শিক্ষায় অভিভাবকদের ভূমিকা।
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১:২৩:৩৩
অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার রয়েছে যেখানে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কম। বিশেষত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে অভিভাবকরা বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়েদের শিক্ষার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যান। অনেক অভিভাবকের মতে, মেয়েদের জন্য উচ্চ শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের মূল ভূমিকা হলো গৃহস্থালির কাজকর্ম করা এবং সংসার পরিচালনা করা। মৃত্যুঞ্জয়ী রাণী, একজন গৃহিণী, বলেন, “আমরা ভাবি, মেয়েরা পড়াশোনা করলে কী হবে? তাদের তো বাসায় থেকেই সংসারের কাজ করতে হবে। তা ছাড়া মেয়ে বড় হলে কিসের জন্য পড়াশোনা করবে? বিয়ে হয়ে তো যাবে। তাই, মেয়েদের পড়ানোর চেয়ে তাদের ঘরকন্নার কাজ শিখিয়ে দেওয়া ভালো।”এ ধরনের মনোভাব দেশের কিছু অঞ্চলে প্রচলিত হলেও, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছু অভিভাবক বিশেষভাবে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহিত করছেন, যেন তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়।
সমাজের চাপ ও পুরোনো ধারণা
নারী শিক্ষার আরেকটি বড় বাধা হল সমাজের পুরানো ধারণা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকাতে, এখনও অনেকেই মনে করেন যে নারীদের সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভের দরকার নেই। একটি সমাজে, যেখানে পুরুষতন্ত্র প্রভাব বিস্তার করেছে, সেখানে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সহজ নয়। সমাজের ধারণা অনুযায়ী, “মেয়ে হওয়া মানেই সংসার করা”, যা নারীদের উচ্চ শিক্ষা ও কর্মজীবনে আগ্রহী হতে বাধাগ্রস্ত করে।এমনকি, শহুরে পরিবেশেও কিছু ক্ষেত্রে সমাজের চাপ নারীদের শিক্ষার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কাজী মনীষা, একজন নারীবাদী এবং শিক্ষাবিদ, বলেন, “আমরা যখন নারীদের কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগিয়ে যেতে দেখি, তখন সমাজের এক অংশ তা ভালো চোখে দেখে না। নারীদের শিক্ষার বিপক্ষে অনেক সমাজই নিজেদের পুরোনো সংস্কৃতি ও ধারণার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে।”
অভিভাবক ও সমাজের মধ্যে টানাপোড়েন
একটি প্রশ্ন উঠে আসে অভিভাবকরা কি শুধুমাত্র সমাজের প্রভাবের কারণেই মেয়েদের শিক্ষার বিপক্ষে অবস্থান নেন? নাকি তাদের নিজস্ব কোনো চিন্তা-ভাবনা রয়েছে, যা তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে অভিভাবকরা বাচ্চাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী, তাদেরকেও সমাজের নানা প্রকার বাধা সম্মুখীন হতে হয়। এক উদাহরণ স্বরূপ, মিরপুরের বাসিন্দা রাশেদা খাতুন, একজন উচ্চ শিক্ষিত মা, বলেন, “আমি সবসময় চেয়েছি আমার মেয়ে ভালো শিক্ষা গ্রহণ করুক। তবে সমাজের চাপের কারণে, বিশেষ করে প্রতিবেশীদের চোখের সামনে, আমি অনেক সময় বিচলিত হই। তারা মনে করে, মেয়েরা পড়াশোনা করে কী করবে, বিয়ে তো হয়ে যাবে। তাই, সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমারও মাঝে মাঝে দ্বিধা তৈরি হয়।”
নারীর সংগ্রাম
এমনকি সমাজে নারীদের শিক্ষার অগ্রগতি রুখে দিতে যে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা অনেক সময় নারীদের নিজস্ব সাহস ও প্রতিরোধের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন নারী সংগঠন, শিক্ষাবিদ এবং আন্দোলনকারীরা সমাজের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নারী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে নারীরা নিজেদের শিক্ষার পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন।
নারী শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রবৃদ্ধির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয় হলেও সমাজের মনোভাব পরিবর্তন করতে আরো কাজ করতে হবে। নারী শিক্ষা এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে চাইলে, প্রথমে সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পরিবারের প্রতি অবিচল সমর্থন এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, সমাজকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। শিক্ষাবিদ সায়মা রহমান বলেন, “শুধু পরিবারই নয়, সমাজেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সমাজকে নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের পথে উৎসাহিত করতে হবে। দেশের সর্বত্র মেয়েদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত করার যে পুরানো ধারণা আছে, তা পরিবর্তন করতে হবে।”
কীভাবে বদলাতে পারে নারী শিক্ষার দৃশ্যপট?
নারী শিক্ষার পরিস্থিতি বদলাতে হলে, কার্যকরী পদক্ষেপ ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নারীদের জন্য সুরক্ষিত এবং সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। পাশাপাশি, শিক্ষকদের, সমাজের এবং সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ নারীদের শিক্ষার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে।
সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন
নারী শিক্ষার পথে মূল বাধা পরিবারের এবং সমাজের ভাবনা। এক্ষেত্রে, যদি অভিভাবক এবং সমাজের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে নারী শিক্ষার জন্য বড় পরিবর্তন সম্ভব। তবে, এই পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন সময় এসেছে, যাতে বাংলাদেশের নারীরা শুধু গৃহস্থালি নয়, রাষ্ট্র এবং সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।