বিজ্ঞানীরা সতর্ক, পৃথিবী বিপদে বিশ্ব উষ্ণায়ন কতটা ভয়াবহ হতে পারে?
প্রকাশিত : ১৫ জুন ২০২৫, ১১:০৪:১৬
জলবায়ু সংকট কি সত্যিই সংকটজনক: বিশ্ব উষ্ণায়ন যে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেটি তারা একাধিকবার বলেছেন। তবে, প্রশ্ন উঠছে কীভাবে আমরা এই সংকট মোকাবেলা করতে পারি? বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় কী বলছেন? এই প্রতিবেদনে আমরা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখব।
বিজ্ঞানীরা কি বলছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একমত হয়েছেন যে, বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি হলে পৃথিবী এক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তাদের মতে, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, এবং অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ আরও তীব্র হবে, যা মানবজীবনকে বিপন্ন করবে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC)-এর রিপোর্ট অনুসারে, যদি এই গতি চলতে থাকে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ হবে, এবং এর ফলস্বরূপ প্রকৃতি ও মানবজাতির উপর অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রভাব পড়বে। বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, যদি তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়ে, তবে এটি পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুতন্ত্র এবং মানবসৃষ্ট পরিবেশের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধিক্য: বিজ্ঞানীদের সতর্কতা
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা গত ৫০ বছরে ৫ গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অতিবৃষ্টির মতো দুর্যোগগুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. শেহেলি মাহমুদ বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক এলাকা যেখানে একসময় বৃষ্টি ছিল, এখন সেখানে খরা চলছে, আবার যেখানে বৃষ্টি হতো না, সেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, যা প্রতিনিয়ত জীবনের জন্য বিপদ তৈরি করছে।" বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছিল, যা বহু মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করেছে। আর এই পরিবর্তন যে জলবায়ু সংকটের ফলস্বরূপ হচ্ছে, সে বিষয়টি বিজ্ঞানীরা বারবার উঠে ধরছেন।
কার্বন নিঃসরণ: সমস্যা কোথায়?
বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৭৫% দায়ী শিল্পায়ন, যানবাহন, এবং ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার। পৃথিবীকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) পরিবেশে অতিরিক্ত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব পরিবেশ সংস্থা (UNEP) এর মতে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ যদি এই গতিতে চলতে থাকে, তবে আমাদের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে, যা পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে। তবে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে প্রতি বছর ৭.৬% পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি: যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয়?
বিজ্ঞানীদের মতে, যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি, পরিবেশের ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বাড়লে এর ফলাফল আমাদের জীবনযাত্রায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্রীষ্মকাল যেমন আরও বেশি তীব্র হবে, তেমনি শীতকালও অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জলবায়ু সংকটের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাও এক বড় হুমকির মুখে পড়বে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৃষ্টির অনিয়মিততা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ফলস্বরূপ, বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে, যা খাদ্য সংকট তৈরি করবে। অবিলম্বে পদক্ষেপের প্রয়োজন: আমাদের করণীয় কী? বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এবং পরিবেশবিদরা বারবার বলছেন, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে হলে আমাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
কার্বন নিঃসরণ কমানো: যে কোনো মূল্যে শিল্পায়ন ও যানবাহনের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি।
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো: সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জলবিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমানো যেতে পারে।
গাছপালা রোপণ ও বনভূমি সংরক্ষণ: পৃথিবীকে রক্ষা করতে গাছপালা রোপণ এবং বন সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি সামগ্রিক এবং ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তা না হলে, খুব শিগগিরই আমাদের হাতে কোনো উপায় থাকবে না।
আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের পদক্ষেপের উপর: জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করা এখন আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা মতামতের বিষয় নয়; এটি আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা। বিজ্ঞানীরা বারবার জানিয়েছেন, আমাদের হাতে এখনও কিছু সময় আছে, তবে যত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেব, ততই ভালো। যদি আজই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবী হয়তো আর বাসযোগ্য থাকবে না। সুতরাং, আজই সময় পদক্ষেপ নিন, নয়তো দেরি হয়ে যাবে।