আপডেট :
০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩:২৯:১০
প্রতি বছর শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে অতিথি পাখিরা। সুদূর সাইবেরিয়া, ইউরোপ বা হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উড়ে আসা এসব পরিযায়ী পাখিদের দল আমাদের হাওর আর জলাশয়গুলোকে করে তোলে মুখর। কিন্তু কোনো মানচিত্র বা জিপিএস ছাড়াই তারা কিভাবে প্রতি বছর নির্ভুলভাবে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়, আবার সঠিক গন্তব্যেও পৌঁছায়, এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের কাছে আজও এক বিস্ময়। এই অবিশ্বাস্য যাত্রার পেছনে রয়েছে প্রকৃতির এক দারুণ কৌশল।
পাখিদের এই পথ চেনার প্রধান অবলম্বন হলো প্রাকৃতিক দিক-নির্দেশনা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাখিদের মস্তিষ্কে একটি সহজাত 'চৌম্বকীয় কম্পাস' রয়েছে। এটি তাদের পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুভব করতে সাহায্য করে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, পাখিদের রেটিনায় 'ক্রিপ্টোক্রোম' নামক এক বিশেষ প্রোটিন থাকে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই প্রোটিনটি পাখিদের চৌম্বক ক্ষেত্রকে আলোর ঢ়ঙের মতো দেখতে সাহায্য করে, যার ফলে উড়ে চলার সময় তারা সঠিক পথটি চিহ্নিত করতে পারে।
এছাড়া এই পথ চেনার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখে সূর্য ও তারা। দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান এবং রাতে আকাশে তারার বিন্যাস দেখে একইভাবে দিক নির্ণয় করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিজ্ঞ পাখিরা ঝাঁকের সামনে থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তবে আরও গভীরের কারণ হলো জিনগত মেমোরি। এই সহজাত প্রবৃত্তি তাদের পূর্বপুরুষদের দেখানো হাজার হাজার মাইল লম্বা পথের মানচিত্রটি যেন জন্মগতভাবেই মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়।
শীতকালে বাংলাদেশে আসা অসংখ্য প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হাঁস, যেমন—বালি হাঁস, পাতি হাঁস, রাজ সরালি। এছাড়াও দেখা মেলে জলপিপি, পানকৌড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির বক, শামুকখোল, চখা-চখি, গাং কবুতর এবং মানিকজোড়ার মতো অপূর্ব সুন্দর পাখিদের। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও হাওরগুলো উষ্ণ আবহাওয়া এবং প্রচুর খাবারের জোগানের কারণে অতিথি পাখিদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য।
তবে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে পাখিদের এই জীবনযাত্রা ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব-এর পরিসংখ্যানে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। তাদের তথ্যমতে, শুধু সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতেই ১০ বছরে অতিথি পাখির সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮৫%।
এছাড়াও অবৈধ শিকার, জলাভূমি ভরাট এবং জমিতে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রকৃতির এই অপূর্ব অতিথিদের কলকাকলি যদি আমরা ভবিষ্যতেও শুনতে চাই, তাহলে তাদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। তাদের রক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগই পারে পরিযায়ী পাখিদের এই জাদুকরী যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে।