প্রকাশিত : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ৯:৪৫:০৬
দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় নানা প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ ক্রেতারা। সরেজমিন রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে বুধবার (৫ নভেম্বর) মানভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। পাইকারি বাজারে যার মূল্য ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা।
মৌসুম শেষে দেশি পেঁয়াজের যোগান স্বল্পতা ও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়তি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ দেশের একাধিক খুচরা বাজার ও মুদি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের দাম গেল সপ্তাহজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা করে বেড়েছে।
রাজধানীর গুদারাঘাট কাঁচা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রিপন মিয়া বলেন, ‘গতকাল বেচছি ১০০ টাকা, আজ মান ভেদে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে আমরা কিনতে পারি সেভাবেই তো বিক্রি করবো। দাম কয়দিনের মধ্যেই বাড়ছে।’
এদিকে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও রাজশাহীর পাইকারি ব্যবসায়ী এবং পেঁয়াজ আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আইপি বা আমদানি অনুমতি অনেকদিন ধরে বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। তাদের মতে, চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কয়েকদিনের মধ্যে যদি যোগান না বাড়ে তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।

যদিও পেঁয়াজের দাম আর বাড়ার কোনো কারণ দেখছে না বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বা ক্যাব। সংস্থাটি বলছে, কিছুদিনের মধ্যেই দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে, এই মুহূর্তে আমদানি অনুমতি যাতে দেওয়া হয় সেজন্য কিছু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের হঠাৎ দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।
ঢাকার উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা রুবেল হোসেন বলেন, ‘গত সপ্তাহে পেঁয়াজ কিনেছি ৬০ টাকা কেজি, আজ কিনলাম ১২০ টাকা দিয়ে। হঠাৎ করেই দাম অনেক বেড়ে গেল।’
বাংলাদেশে খাদ্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা অনেকটা নিয়মিত বিষয়। বিশেষ করে যেসব পণ্য আমদানি করতে হয় সেগুলো নিয়ে বছরের কোনো না কোনো সময় নানা আলোচনা-সমালোচনা, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটসহ নানা বিষয় সামনে আসে।
এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। হঠাৎই গত ১০ দিনের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যার কারণ হিসেবে দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হওয়া এবং পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ বন্ধ থাকাকেই দুষছেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা।
এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে যোগান ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে ক্রেতাদের মধ্যে। অনেকেই এমন প্রশ্ন তুলছেন যে, একদিনের ব্যবধানে একটি পণ্যের দাম কীভাবে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়ে?
পেঁয়াজ আমদানিকারক ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আহসান উল্লাহ জাহেদী বলছেন, অনেকদিন যাবৎ দেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় যোগানের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
যদিও দেশের উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বলেই মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্য নিয়েও কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে যার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন। আর দেশীয় উৎপাদন প্রায় ২১ লাখ টন। এই হিসেবে প্রতি বছর ছয় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

যদিও সরকারের এই পরিসংখ্যান প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন। তিনি বলছেন, দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তাতে আমদানি করার প্রয়োজন হয় না। তিনি আরও বলেন, ‘বাজার তদারকির দুর্বলতাও দাম বৃদ্ধির কারণ। যেভাবে দাম বাড়ছে এটা তো হওয়ার কথা না। যে স্টক আছে তাতে নতুন পেঁয়াজ আসা পর্যন্ত আমাদের চাহিদা পূরণ হওয়ার কথা।’
দাম কি আরও বাড়তে পারে
বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা গত দশ দিন ধরে অনেকটাই ধারাবাহিক। আমদানি বন্ধ থাকায় যেহেতু দেশি পেঁয়াজই এই মুহূর্তে বড় নির্ভরতা, তাই নতুন মৌসুমের ফলন না আসা পর্যন্ত কিছুটা বাড়তি দামের প্রবণতা থাকতে পারে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবছর কিছুটা দেরিতে উৎপাদনের কাজ শুরু করায় নতুন পেঁয়াজ জমি থেকে ঘরে তুলতেও আরো কিছুটা সময় লাগবে কৃষকদের। রাজবাড়ীর কৃষক ছোরাপ আলী বলছেন, ‘অন্য বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকেই রবি মৌসুমের পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পারি। কিন্তু এবার পেঁয়াজ শুরু করতেই দেরি হয়ে গেছে।’
তবে আগের মৌসুমে যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে তাতে ঘাটতি তৈরির সুযোগ নেই বলেই মনে করেন ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন। তিনি বলছেন, ‘বাজার তদারকি বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ বন্ধ করা গেলে এই সময়টুকু সহজেই পার করা যাবে।’
এ বছর আমদানির সুযোগ বন্ধ থাকায় প্রতি বছরের মতো এবারও এই সময়ে যোগানের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। নতুন পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলেই মনে করেন ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকরা বলছেন, এই সময়ের জন্য আমদানির সুযোগ দেওয়া না হলে আগামী কয়েকদিনে দাম আরও বাড়তে পারে।
পেঁয়াজ আমদানীকারক জাহেদী বলেন, ‘সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। দুই মাস আগে অল্প কিছু পেঁয়াজ এসেছিল ভারত ও চীন থেকে। সরকার আজকে যদি আইপি খোলার অনুমতি দেয় তাহলে কালকেই তার প্রভাব বাজারে পড়বে।’
প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানির সুযোগ রাখার কথা বলছেন ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেনও। তিনি বলছেন, ‘সরকারের উচিত আমাদের আমদানি নীতিটা একেবারে ফিক্সড না করা। অর্থাৎ যখন লোকাল প্রোডাক্ট থাকবে তখন আমদানি নিরুৎসাহিত করা, আবার যখন থাকবে না তখন আমদানির সুযোগ দেওয়া।’
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা