আপডেট :
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:০৪:১১
২০২৫ সালে এসে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সংসদীয় কাঠামো এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিজেপির কোনো নির্বাচিত মুসলিম সংসদ সদস্য নেই। দলটির ইতিহাসে এবং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
১. সংসদীয় পরিসংখ্যানের চিত্র
ভারতের সংসদের (লোকসভা) বিজেপির মুসলিম প্রতিনিধিত্বের বর্তমান অবস্থা নিচে তুলে ধরলাম:
লোকসভা (নিম্নকক্ষ): ০ জন এমপি
বর্তমানে লোকসভায় বিজেপির কোনো মুসলিম প্রতিনিধি নেই।
২. নির্বাহী বিভাগ:
মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী: ০ জন
নির্বাহী পর্যায়েও মুসলিম প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
৩. জনসংখ্যার হার বনাম প্রতিনিধিত্ব:
ভারতের মোট জনসংখ্যা এবং সে তুলনায় বিজেপির দলীয় প্রতিনিধিত্বের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।
- ভারতের মোট মুসলিম জনসংখ্যা: ২০-২১ কোটি
- ভারতের মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম: ১৪.২-১৫ শতাংশ
- বিজেপির মোট এমপির মধ্যে মুসলিম: ০ শতাংশ
- কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মুসলিম: ০ শতাংশ
৪. বিজেপি কেন মুসলিম প্রার্থী দিতে অনাগ্রহী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল কাজ করছে:
বিজেপির প্রধান নির্বাচনী কৌশল হলো ‘হিন্দু ঐক্য’। তাই দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন সংহত করার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।
বিজেপি প্রথাগত ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ বা প্রতিনিধিত্বের বদলে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একীকরণ’ (Hindu Consolidation) নীতি গ্রহণ করেছে। তারা প্রমাণ করেছে যে, সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর নির্ভর না করেও কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটের মেরুকরণ ঘটিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসা সম্ভব।
- ‘উইনেবিলিটি’ বা জেতার ক্ষমতা:
বিজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করে যে, তারা ধর্মের ভিত্তিতে নয় বরং কে জিততে পারবেন তার ওপর ভিত্তি করে প্রার্থী নির্বাচন করে। বর্তমান মেরুকরণের রাজনীতিতে বিজেপি মনে করে তাদের ব্যানারে মুসলিম প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা কম।

৫. কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক সংকট
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ঐতিহাসিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি করে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে তারা এক কঠিন সংকটে।
কংগ্রেস মুসলিম ভোট ধরে রাখতে গিয়ে বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
- সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিমুখ হওয়া:
বিজেপি সফলভাবে ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, কংগ্রেস কেবল মুসলিমদের স্বার্থ দেখে। একে তারা ‘Minority Appeasement’ বা সংখ্যালঘু তোষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মুসলিম ভোট নিশ্চিত করতে গিয়ে কংগ্রেস উত্তর ও মধ্য ভারতের বিশাল হিন্দু জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হিন্দু ভোটাররা দলে দলে কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে, কারণ তারা মনে করছে কংগ্রেস তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে অবজ্ঞা করছে।
হিন্দু ভোটারদের মধ্যে এই ধারণা গেঁথে গেছে যে কংগ্রেস কেবল সংখ্যালঘুদের স্বার্থ দেখে, যা কংগ্রেসের জন্য গণবিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা:
বিএনপি, বর্তমানে হিন্দু মাইনোরিটি ভোটারদের আকৃষ্ট করতে অনেক হিন্দু প্রার্থী দেওয়ার কৌশল নিচ্ছে। ভারতের কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা থেকে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে:
কংগ্রেসের মতো কেবল একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে গিয়ে যদি মেজরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে অবজ্ঞা করা হয়, তবে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ভারত থেকে দেখা গেছে যে, যখন কোনো দল অতিরিক্ত মাত্রায় সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করে, তখন প্রতিপক্ষ দল খুব সহজেই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার বিপন্ন’ হওয়ার ওয়াজ তৈরি করে মেজরিটি ভোট ব্যাংকে ধস নামাতে পারে।
- প্রার্থিতা বনাম জনপ্রিয়তা:
কেবল হিন্দু প্রার্থী দিলেই হিন্দু ভোট নিশ্চিত হয় না, যদি না সেই দল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে। ভারতের কংগ্রেস মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি, কারণ তারা হিন্দু ভোটারদের আস্থা হারিয়েছিল।
উপসংহার
ভারতের বর্তমান রাজনীতি একটি কঠোর সত্য তুলে ধরছে—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যার গুরুত্ব অপরিসীম। বিজেপি প্রমাণ করেছে যে তারা মেজরিটি ভোটারদের আবেগ বুঝতে পেরেছে, যেখানে কংগ্রেস মাইনোরিটি নির্ভর রাজনীতি করতে গিয়ে মূলধারার জনমত হারিয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপির জন্য এটি একটি বড় সতর্কবার্তা যে, সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মুসলমান সেন্টিমেন্ট বা অধিকারের প্রশ্নে আপস করা না হয়, নতুবা ভারতের কংগ্রেসের মতো জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।