আপডেট :
২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৭:৩৭
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি নামসর্বস্ব বা ‘শেল’ কোম্পানি গাজার অসহায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে কাজে লাগিয়ে তাদের জোরপূর্বক দেশত্যাগে সহায়তা করছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মানবিক সহায়তার আড়ালে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়তে প্ররোচিত করার এই প্রক্রিয়াকে গাজা উপত্যকা থেকে পরিকল্পিতভাবে মানুষ উচ্ছেদের, এমনকি ‘জাতিগত নিধনের’ একটি অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানে গত মাসে গাজা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫৩ জন ফিলিস্তিনিকে বহনকারী একটি রহস্যময় ফ্লাইটের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘আল-মাজদ ইউরোপ’ নামে একটি অনিবন্ধিত ও ভুয়া মানবিক সংস্থা এই ফ্লাইটের নেপথ্যে কাজ করেছে। সংস্থাটি নিজেদের ত্রাণ কার্যক্রমের কথা বললেও বাস্তবে তারা গাজাবাসীদের দেশত্যাগে উৎসাহিত করছিল।
গত ১৩ নভেম্বর ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ ও প্রিটোরিয়ার ওআর তাম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। তবে তাদের পাসপোর্টে ইসরায়েলের কোনো বহির্গমন সিল না থাকায় সীমান্ত পুলিশ প্রথমে প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রায় ১২ ঘণ্টা বিমানে আটকে থাকার পর ‘মানবিক বিবেচনায়’ শেষ পর্যন্ত তাদের নামতে দেওয়া হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, তার সরকার এই ঘটনাটি তদন্ত করবে। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সমর্থক দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সন্দেহ—এই মানুষগুলোকে গাজা থেকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে গাজা ছাড়াকে ‘স্বেচ্ছা হিজরত’ বলে অভিহিত করলেও বাস্তবে এটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজা ত্যাগে উৎসাহিত করতে একটি বিশেষ ব্যুরো গঠন করে, যার প্রধান করা হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক ইয়াকভ ব্লিটস্টাইনকে। সে সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দাবি করেছিলেন, গাজার ৪০ শতাংশ বাসিন্দা দেশ ছাড়তে আগ্রহী।
এর ঠিক আগের মাসে আল-মাজদ ইউরোপ তাদের ওয়েবসাইট চালু করে এবং দাবি করে তারা মুসলিম দেশগুলোতে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে ও গাজাবাসীদের বিদেশে যেতে সাহায্য করছে। তারা ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চিকিৎসকদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থার কথাও বলে।
ফ্লাইটের এক যাত্রী জানান, শুরুতে তাকে বিনা খরচে বের করে দেওয়ার কথা বলা হলেও পরে জনপ্রতি ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত আদায় করা হয়। যাত্রীদের জানানো হয়, বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে এবং ফ্লাইটের কয়েক ঘণ্টা আগেই কেবল বিস্তারিত জানানো হয়।
যাত্রীরা দক্ষিণ গাজার কারেম আবু সালেম ক্রসিং দিয়ে ইসরায়েলের তত্ত্বাবধানে ইলাতের কাছে র্যামন বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। ফ্লাইইউ নামের একটি নতুন এয়ারলাইন্সে করে তাদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই এয়ারলাইন্সটি বিভিন্ন দেশে এমন আরও ফ্লাইট পরিচালনা করেছে।
আল-মাজদ ইউরোপ নিজেদের ২০১০ সালে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত একটি মানবিক ফাউন্ডেশন দাবি করলেও কোনো ইউরোপীয় ডেটাবেসে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দেওয়া ঠিকানাও ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনুসন্ধানে সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত দুই ফিলিস্তিনি ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, যাদের একজনের দেশত্যাগের তথ্যও শনাক্ত করা হয়েছে।
আল-জাজিরার অনুসন্ধান বলছে, আল-মাজদ ইউরোপ একটি ভুয়া মানবিক সংস্থা। প্রশ্ন উঠেছে, মানবিকতার আড়ালে গাজাকে জনশূন্য করার কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনাই কি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে?