ঢাকা সিটি কলেজে অধ্যক্ষকে জোর করে সরিয়ে নতুন অধ্যক্ষের চেয়ারে বসা থেকে শুরু শিক্ষকদের অপমান, মানসিক বিপর্যয় ও মৃত্যুর ঘটনা ছড়িয়েছে সারাদেশে
প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০৯:৩০
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা আতঙ্কজনক মাত্রায় পৌঁছায়। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা রাজধানীর নামকরা প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি কলেজে, যেখানে ৭ আগস্ট ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল হক জোর করে অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিনকে পদত্যাগে বাধ্য করে চেয়ারে বসেন। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন বেদখল ও বিশৃঙ্খলা স্থায়ী রূপ নিতে শুরু করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাঙন শুরু হয় রাজধানী থেকে
প্রথম দফায় বিশৃঙ্খলার শিকার হয় রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল। ঢাকা সিটি কলেজ ছাড়াও লালবাগের রহমতুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, শাহ আলী মহিলা কলেজ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে, অনেক শিক্ষক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণও করেন।
সারাদেশে ছড়ায় সহিংসতা ও অপমানের ছায়া
ঢাকার বাইরে বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, লালমনিরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুড়িগ্রামসহ প্রায় সব জেলা থেকেই একাধিক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের জোর করে পদত্যাগ করানো ও বিশৃঙ্খলার খবর এসেছে। কুমিল্লার দেবীদ্বার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী আলমগীরকে মারধর করে সরিয়ে তার চেয়ারে বসানো হয় এক ছাত্রকে সেই ছবিও ভাইরাল হয়। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ গল্লাক আদর্শ ডিগ্রি কলেজে পদ দখলকে কেন্দ্র করে একজন নিহত হন।
শিক্ষকদের হতাশা, শিক্ষার্থীদের ট্রমা
অনেক শিক্ষক এখনো তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ সরকারি বেতন পেলেও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্য পাচ্ছেন না, স্বপদে ফিরতে পারছেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর হতাশা বিরাজ করছে। নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাদ যায়নি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েট, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও জোর করে উপাচার্য বা কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। কুয়েটের পরিস্থিতি এখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি বলে জানা গেছে।
দায়ীদের শনাক্তে কোনো উদ্যোগ নেই
যদিও এসব ঘটনার প্রকৃত পরিসংখ্যান কোনো দফতরে নেই, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও শিক্ষকদের সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোর করে পদ দখলের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রশাসন কিংবা শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে কোনও দৃশ্যমান তদন্ত বা দায়ী চিহ্নিতকরণের চেষ্টা দেখা যায়নি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি কী বলছে?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, “বেসরকারি কলেজগুলোতে মনিটরিং করতে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে তিন মাসের মধ্যে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবো।”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি আমরা সার্বক্ষণিক মনিটর করছি। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরেছে।”
সামগ্রিক বিশ্লেষণ ও আশঙ্কা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো সংবেদনশীল জায়গায় দখল, লাঞ্ছনা ও সহিংসতা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে বিশৃঙ্খলা রাজনীতির পতনের পর শিক্ষা অঙ্গনে ঢুকেছে, তা ঠেকাতে এখনই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে — এমন সতর্কবার্তা দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।