প্রকাশিত : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ৩:৫৯:৪১
ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর বাজার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। বাজারের পাশে খোলা একটা স্থানে কয়েকটি বেঞ্চ বসানো। গোল হয়ে সেখানে বসেছেন ১০-১২ জন ব্যক্তি। তাদের সকলেই সনাতন ধর্মের অনুসারী। এর মধ্যে দলীয় লিফলেট বিতরণ করছিলেন স্থানীয় জামায়াতের একজন নেতা। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, সনাতন ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে এটি তাদের একটি ‘দলীয় সভা’।
তার ভাষায়, সভায় যারা এসেছেন তাদের সকলেই জামায়াতে ইসলামীর ‘সমর্থক’। উমেদপুর ইউনিয়ন জামায়াতে আমির মো. শওকত আল বলেন, ‘আমরা কয়েকমাস ধরে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কাজ করছি। তারা রাজনৈতিকভাবে আমাদের সমর্থক হয়েছেন, দাঁড়িপাল্লার সমর্থক হয়েছেন।’
তিনি জানান, জামায়াতের কেন্দ্র থেকেই ভিন্ন ধর্মের যারা আছেন, তাদের কাছে দলের ‘রাজনৈতিক’ আহ্বান পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা আছে।
ঝিনাইদহে জামায়াত যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি এ রকম বিভিন্ন ঘটনা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। যেগুলোতে বলা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীতে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কেউ কেউ যোগ দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও জামায়াতের ‘সনাতনী কমিটি’ গঠনের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
এমনকি সপ্তাহখানেক আগে দেশটির দক্ষিণের জেলা খুলনার ডুমুরিয়ায় শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের একটি ‘হিন্দু সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থি একটি দলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যোগদানের কথা অতীতে সেভাবে শোনা যায়নি।
তবে সম্প্রতি এমন খবর সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে, দলটিতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের যোগদান বা অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাস্তবিক অর্থে কতটা আছে? আর জামায়াতই বা কেন সংখ্যালঘুদের দলে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
ঝিনাইদহের শৈলকূপায় জামায়াতের সভাটিতে যাদের ‘সমর্থক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন জামায়াত নেতারা, তাদেরই কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। গ্রামটিতে নজীরবিহীনভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারও কারও এরকম জামায়াতে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে তাদের কেউ কেউ তুলে ধরেন ‘নিরাপত্তার আশ্বাসের’ কথা। তাদের ভাষায়, ৫ আগস্টের পর হিন্দু বসতিগুলোয় এক ধরনের ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পরে জামায়াত নেতারা তাদের এসে ‘নিরাপত্তার আশ্বাস’ দিয়েছেন।
অমল কুমার নামে একজন সনাতন ধর্মানুসারী বলেন, ‘ওরা এসে আমাদেরকে বলে যে, তোমরা যদি কোনো বিপদে-আপদে পড়ে যাও, তাহলে আমরা সহযোগিতা করবো, তোমাদের পাশে দাঁড়াবো। তারা আমাদের মোবাইল নম্বরও নিয়ে রাখছে। এখন এরকম সাপোর্ট তো অন্যরা কম দিয়েছে। তারা সাপোর্ট দিছে বলে আমরা তাদের সাপোর্ট দিচ্ছি।’
একই রকম কথা বলেন আরও কয়েকজন।
উমেদপুর ইউনিয়নের জামায়াত নেতা শওকত আলীও বলছিলেন, ‘আমরা তাদের এ কারণেই আহ্বান করছি যে তারা আমাদের প্রতিবেশী, তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করবেন। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। তাদেরকে আমরা আহ্বান জানিয়েছি, আমাদের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হচ্ছে ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। তারা আমাদের কাছে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার পাবেন সবসময়’
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পরও দেশটির বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ও নিরাপত্তা সংকটের কথা তুলে ধরেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। দেখা যাচ্ছে, এই নিরাপত্তা সংকটকেও জামায়াত স্থানীয়ভাবে কাজে লাগাচ্ছে সনাতন ধর্মানুসারীদের কাছে যেতে।
জামায়াতে কি হিন্দুদের যোগ দেওয়া বা নেতৃত্বের সুযোগ আছে?
জামায়াত একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল, যেখানে মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্বপূর্ণ। দলটির উপরের স্তরে উঠতে কিংবা নেতৃত্বে জায়গা পেতে ধর্মীয় বিষয়গুলো মূল ভূমিকা পালন করে। ফলে এমন একটি দলে ভিন্ন ধর্মের কেউ কীভাবে যোগ দেবেন কিংবা যোগ দিলেও সেটা বাস্তবিক অর্থে দলে তার কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এছাড়া এমন দলে ভিন্নধর্মের কেউ যোগ দলে তার দলীয় কার্যক্রম কী হবে সেটাও স্পষ্ট নয়।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, জামায়াতের গঠনতন্ত্র মেনেই তারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমর্থক হিসেবে যারা ‘জামায়াতে আসতে আগ্রহী’ তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের গঠনতন্ত্রেই অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিধান আছে। তবে তাদেরকে মুসলমানদের মতো কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, জামায়াতের শৃঙ্খলা মেনে চলা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন না করা -এরকম চারটি শর্ত মানলেই ভিন্ন ধর্মের লোকেরা আমাদের সদস্য হতে পারবেন।’
তবে তার পরও প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে থাকলেও দলটিতে ভিন্ন ধর্মের অনুসরাীদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ বাস্তবে নেই বলেই সমালোচনা আছে। এর কারণ হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিলেও দলের কোনো পর্যায়ের নেতৃত্ব কিংবা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ভিন্নধর্মের কারো যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি দলটির গঠনতন্ত্রে। ফলে দলটি বাস্তবিক অর্থে কতটা সব ধর্মের অনুসারীদের দলে সুযোগ দিচ্ছে সেটা অস্পষ্ট।
তবে জামায়াত এতে সমস্যা দেখছে না।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘তারা তাদের ফোরামে লিডার হবেন। মূল জামায়াতের নেতৃত্বে আসবার তো আমাদের বিধি-বিধান অনুযায়ী সুযোগ নেই। তারা তাদের কমিউনিটির লিডার হবেন। ওই কমিউিনিটির মধ্যে তারা কাজ করবেন, বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করবেন, স্থানীয়ভাবে তাদের কোনো কমিটি হলে সেখানে তারাই নেতৃত্ব দেবেন।’
কিন্তু তাহলে দলটি কতটা কার্যকরভাবে ‘ইনক্লুসিভ’ হলো?
এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তিনি তো আমার দলে যোগ দিলেই সহযোগী হয়ে গেলেন। এটা তো তার অন্তর্ভুক্তি হয়ে গেল। ইনক্লুসিভ মানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। তারপর তার স্ট্যান্ডার্ড, যোগ্যতা, দক্ষতা কী আছে, কতটা আছে সেটা আবার আরেকটা চ্যাপ্টার।’
নজর হিন্দু ভোটব্যাংকে?
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ১০ শতাংশ। দেশটির বিভিন্ন আসনে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে সংখ্যালঘু ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়কালে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোট কোন দিকে যাবে সেটা একটা বিষয়।
তবে অনেকেই মনে করেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিএনপির অবস্থান থাকলেও ইসলামপন্থি দল হওয়াসহ ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে জামায়াত সেখানে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ফলে জামায়াত যে এখন তাদের ভাষায়, অমুসলিম সমর্থক বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে, তার একটা বড় কারণ এই সংখ্যালঘু ভোটার আকৃষ্ট করা।
সপ্তাহখানেক আগে খুলনায় শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের যে ‘হিন্দু সম্মেলন’ হয়েছে, সেটাও ছিল মূলত নির্বাচনী জনসভা, যেখানে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে দেখা যায়। এছাড়া যেসব আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার আছে, সেগুলোতে নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোটারদের রাখা হবে এমনকি নির্বাচনী কমিটিগুলোতেও তাদের স্থান দেওয়ার কৌশল আছে জামায়াতের।
যদিও জানতে চাইলে মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, সংখ্যালঘু কিংবা হিন্দু ভোটারদের ভোটব্যাংক হিসেবে নয়, বরং নাগরিক হিসেবেই তারা বিবেচনা করেন। তিনি বলেন, ‘তারা ভোটার, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এটাই তো সবকিছু নয়। আমরা তাদেরকে ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করছি না, আমরা তাদের পাশে থাকতে চাই।’
তবে জামায়াত যেটাই বলুক, দলটির বিভিন্ন স্থানে সনাতনী কমিটি গঠন করা এবং হিন্দুদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সন্দেহ, সংশয় আছে।
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ মনে করেন, কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ না দিয়ে দলে ভিন্নধর্মের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করলে সেটা বাস্তবে কোনো পরিবর্ত আনবে না।
তিনি বলেন, ‘তারা যেহেতু একটা ধর্মভিত্তিক দল, তাদের যে ধরনের চিন্তা-চেতনা, গঠনতন্ত্র, সেখানে অন্য ধর্মের লোককে ধারণ করার সুযোগ সেরকম নেই। এটা একটা ভোটের রাজনীতি, ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল। কারণ তাদেরকে দলে নিলো, কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজ দিলো না, তাহলে সেটা তো ক্ষণস্থায়ী। এটা দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলবে না।’
মনীন্দ্র কুমার নাথ মনে করেন, জামায়াত কিংবা এরকম রাজনৈতিক দলের যেভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন বা হুমকি বন্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার ছিল, সেটা করছে না। ফলে শুধু ভোট কিংবা দলে সদস্য বানিয়েই সংখ্যালঘুদের সমমর্যাদা, সমান অধিকার এবং নিরাপত্তার যে সংকট সেটা মিটবে না।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা