আপডেট :
১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯:৪৩:৪৪
উপরে, অসহায় এক মা বুক চাপড়াচ্ছেন, তার কানে তখনো বাজছে শেষবারের মতো শোনা ‘মা মা’ ডাক। নিচে, ৬০ ফুট গভীরে, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে শুরু হলো এক অসম লড়াই। মাটি খননের শব্দে চাপা পড়ে গেল প্রকৃতির সব স্বাভাবিক সুর। শত শত মানুষের প্রার্থনা, ফায়ার সার্ভিসের অবিরাম চেষ্টা—সবই যেন আটকে রইল সেই সরু, নির্মম গর্তের মুখে। ৩২টি দীর্ঘ, কষ্টদায়ক ঘণ্টা... আশা আর নিরাশার এই চরম নাটকের যবনিকা পড়ল গভীর রাতে, যখন নীরবতা ভেঙে উচ্চারিত হলো সবচেয়ে কঠিন সত্যটি: শিশু সাজিদ আর নেই।
যার হাসিতে ভরে থাকার কথা ছিল এই জগৎ। কিন্তু নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গেল মাটির নীচে, এক হিমশীতল অন্ধকারে, তারপর সেখান থেকে অনন্তের কোলে। অন্ধকার গহ্বর থেকে যখন তাকে তুলে আনা হলো, তখন তার ছোট্ট নিথর দেহে লেগে ছিল মাটির শেষ চুম্বন। সে চাঁদ আর কখনো হাসবে না, তার খেলাধুলার শব্দে আর মুখরিত হবে না কোয়েলহাটের উঠোন। শুধু পড়ে রইল এক বুক হাহাকার, আর একটি প্রশ্ন, কেন একটি নিষ্পাপ প্রাণকে এভাবে কেড়ে নিল নিয়তির গভীর গর্ত?
রাজশাহীর তানোরের কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামের এই মর্মান্তিক ঘটনায় স্তব্ধ গোটা দেশ। মাটির নীচে অন্ধকার গহ্বরে ৩২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই শেষে দুই বছরের শিশু সাজিদ চিরতরে বিদায় নিয়েছে। যে বয়সে মায়ের আঁচলই ছিল তার সবথেকে নিরাপদ আশ্রয়, সেই আঁচল ধরে থাকা অবস্থাতেই নিমেষে সে তলিয়ে যায় ৬০ ফুট গভীর এক সরু গর্তে।
বুধবার দুপুরে মা রুনা খাতুন তার দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটছিলেন। একটু অসাবধানতাবশত যাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন, সেই ছোট্ট সাজিদ পিছু পিছু আসতে গিয়েই পিছলে পড়ে গেল ৮ ইঞ্চি ব্যাসের নলকূপের পরিত্যক্ত গর্তটিতে। "মা মা কইরা ডাকছে,"—অসহায় মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ সেই মুহূর্তের বিভীষিকা বর্ণনা করে।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এক জীবন-মৃত্যুর কঠিন যুদ্ধ। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট, পুলিশ এবং স্থানীয় মানুষ একটানা ৩২ ঘণ্টা ধরে মাটি কেটে, ভেন্টিলেশন পাইপ এর মাধ্যমে অক্সিজেন দিয়ে শিশুটিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালান। গভীর গর্তের মাটি বারবার ভেঙে পড়ায় উদ্ধারকাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ধীরগতির।
অবশেষে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে অচেতন অবস্থায় সাজিদকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় প্রকৃতি। তানোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ৯টা ৪০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাজিদকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুপুর একটায় গর্তে পড়েছিল যে শিশু, পরদিন বিকেল সাড়ে চারটার পর তার আর কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়নি। হয়তো অন্ধকারেই নিভে গিয়েছিল তার ছোট্ট প্রাণ। নলকূপ বসানোর নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে খনন করা একটি পরিত্যক্ত গর্ত কেড়ে নিল দুই বছর বয়সী একটি নিষ্পাপ জীবন। সাজিদের এই করুণ পরিণতি কাঁদিয়ে তুলেছে প্রতিটি সংবেদনশীল হৃদয়কে। তার এই বিদায় গোটা জাতির দিকে প্রশ্ন রেখে গেল আর কত সাজিদের প্রাণের বিনিময়ে বন্ধ হবে এই গর্ত, আর কত প্রাণের বিনিময়ে টনক নড়বে আমাদের?