প্রকাশিত : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ৩:৫৬:২০
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির বিজয় যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এটি শুধু রাজনৈতিক ফল নয়, বরং নৈতিকতার মধ্যদিয়েই পুরোনো ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে দেওয়া। আগে রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য প্রভাব বিস্তার আর অর্থবিত্তকে গুণ হিসেবে দেখা হতো। আজ সেখানে বিলিয়নিয়ারদের সহায়তা, ইসলামোফোবিয়া এবং নিজ দলের নেতৃত্বের বিরোধিতা, সবকিছুকে ছাপিয়েই জয়ী হলেন মামদানি। এই বিজয় জানিয়ে দিল, ক্ষমতার পুরোনো অঙ্ক আর কাজ করছে না।
দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্ব সহানুভূতির ভাষায় কথা বললেও নীতি নির্ধারণে গুরুত্ব দিয়েছে বিশাল অঙ্কের অর্থায়নকারী ও লবিস্টদের। মামদানি তার প্রচারণায় সেই ভণ্ডামিকেই তুলে ধরেছেন। মামদানি বিশ্বাস করেন, সরকার শ্রমজীবী মানুষের জন্য, লবিস্টদের জন্য নয়।
অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুওমো ছিলেন সেই রাজনীতির প্রতীক, যা ভোটারদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট ও প্রভাবশালী দাতাদের সমর্থনে কুওমো কেলেঙ্কারির দাগ মুছে ক্ষমতাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন। প্রচুর বিজ্ঞাপন, সমর্থন আর অর্থের পরেও ভোটাররা জানতেন, এই রাজনীতি পুরোনো ঘরানার এবং এর কোনো মূল্য এখন আর নেই।
প্রাথমিক নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্বের আচরণ ছিল আরও বিতর্কিত। কুওমোর বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের বহু অভিযোগ জানার পরও দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে সমর্থন দেন। এতে স্পষ্ট হয়, তাদের নৈতিক অবস্থান দাতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
এছাড়া প্রাথমিকভাবে যখন বেশিরভাগ প্রার্থী ইসরায়েল ভ্রমণকে প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ঘোষণা করছিলেন, সেখানে মামদানি স্পষ্ট করে বলেন, তিনি নিউইয়র্কের মেয়র হতে চান, বিদেশনীতির দূত নন। তার এই সততা রাজনৈতিক মহলে সমালোচিত হলেও ভোটাররা সাহসিকতা হিসেবেই দেখেন।
কুওমোর সমর্থকরা মামদানিকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে আক্রমণ করলেও, এই চালাকি এবার অনেকটাই ভেস্তে যায়। ট্রাম্প যেটিকে ‘কমিউনিজম’ বলেছিলেন, ভোটাররা তা দেখেছেন রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য ব্যবহারের অঙ্গীকার হিসেবে।
ইসরায়েলি নীতির সমালোচনা করায় মামদানিকে ইহুদি-বিদ্বেষী বলা হলেও, ভোটাররা এই অভিযোগকেও গুরুত্ব দেননি। কারণ এই অভিযোগ এত বেশিবার ব্যবহার হয়েছে যে, তা ওজন হারিয়ে ফেলেছে।
বরং কুওমো ও তার সমর্থকদের প্রকাশ্য ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদী আক্রমণই ভোটারদের আরও দূরে সরিয়ে দেয়। এর মধ্যদিয়েই মামদানির বিজয় প্রমাণ করেছে, ভয় নয়, ন্যায়-নীতিই নিউইয়র্কবাসীর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরায়েল ইস্যুতে বিভক্ত ছিল এই নির্বাচন। মামদানি এমন কিছু বলেছেন, যা খুব কম মার্কিন রাজনীতিক সাহস করে বলেন। তিনি ইসরায়েলকে বৈষম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং গাজায় চালানো হামলাকে বলেছেন ‘গণহত্যা’। বিপরীতে কুওমো রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী আচরণে ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থন জানিয়ে এটিকে ‘চরমপন্থা’ নয়, বরং ‘দায়িত্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ভোটারদের কাছে এই চরমপন্থাই ছিল প্রকৃত সমস্যা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম পুরোনো ট্যাবু মানতে নারাজ, যেহেতু তারা গাজার ভয়াবহতা সরাসরিই দেখেছেন।
পাশাপাশি, ডেমোক্র্যাটিক শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকাও ছিল হতাশাজনক। এর মধ্যে সিনেটর চাক শুমার দেননি সমর্থন, প্রতিনিধি হাকিম জেফ্রিসও সমর্থন দেন শেষ মুহূর্তে, যখন মামদানির জয় প্রায় নিশ্চিত। এতেই স্পষ্ট, দলের নেতৃত্ব এখনো দাতাদের রাজনৈতিক চাহিদায় বন্দি।
নিউইয়র্কের বার্তা পরিষ্কার, অর্থ আর প্রভাব নয়, দরকার ন্যায়ের রাজনীতি। সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এই শহরের মানুষ দেখিয়েছে, নীতির ওপর দাঁড়ানো রাজনীতিকেই চায় মানুষ।
মামদানিকে নির্বাচিত করে নিউইয়র্কবাসী প্রমাণ করেছে, বিবেক এখনো পুঁজির চেয়ে শক্তিশালী। এই বিজয় যদি ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্বকে না জাগিয়ে তোলে, তবে নতুন প্রজন্ম তাদের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত।
লেখক
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল