‘কখন ভূমিকম্প হইছে তার কিছুই জানি না আমি, ‘ভূমিকম্পের দেড় ঘণ্টা আগে আমি ঘুম থেকে উঠে পড়েছি আজ, কিন্তু তারপরও কিছুই অনুভব করিনি’, ‘ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে এসে দেখছি দেশে ভূমিকম্প হয়েছে’- রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এরকম প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো, একই সময়ে একই স্থানে থাকার পরও কেন সবাই ভূমিকম্প অনুভব করে না?
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মূল কারণ সংবেদনশীলতা ও ব্যক্তির অবস্থান।
যে কারণে অনুভূতির তারতম্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আপনি কত তলায় আছেন, তার ওপর এটি নির্ভর করছে। আপনি যত উপরের দিকে থাকবেন, আপনার ঝাঁকুনিটা অনুভব করার সম্ভাবনা তত বেশি। যত নিচে থাকবেন, এটি অনুভব করার সম্ভাবনা তত কম।’
তবে এখানে আরেকটি বিষয় হলো–– ‘কিছু কিছু মানুষ গতি খুব ভালো অনুভব করতে পারে।’
তিনি বলেন, তার মতে, যারা ভূমিকম্প টের পায় না তাদের সেনসিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা কম। অনেকে আছেন, যারা উচ্চতা নিতে পারেন না। ছাদ থেকে নিচে তাকাতে পারেন না। কারণ তারা উচ্চতার বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। মোশন বা গতির ক্ষেত্রেও তাই।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে কেউ কেউ সংবেদনশীল হবেন, সেটি স্বাভাবিক হলেও ‘ভূমিকম্পের সময় ব্যক্তি কোন অবস্থায় ছিল, তার ওপরেও তার টের পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে।’
শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘যিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তার ভূমিকম্প টের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেউ যদি চলাচলের মাঝে থাকে, তার টের পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যিনি রান্না করছেন বা দৌঁড়াচ্ছেন তিনি টের না পেলেও যিনি চুপচাপ টেবিলে বসে কাজ করছেন, তার টের পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।’
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়।
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, নরসিংদীর মাধবদীতে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি সারা দেশে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়, এর উৎপত্তিস্থল তিব্বতের শিগেৎসে শহরে। সেখান থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দূরত্ব ৬১৮ কিলোমিটার বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
একই মাসে অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারিও বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো। তবে সেটি ছিল মাঝারি মাত্রার, আজকের মতো এতটা তীব্র ছিল না।
চলতি বছরের শুরুতেই হওয়া ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও ছিল বাংলাদেশের বাইরে। রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের হোমালিন এলাকায়, ঢাকার সঙ্গে যার দূরত্ব ৪৮২ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা—এ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বড় বড় ফল্ট আছে।
মূলত, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।
সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।
যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ‘ফল্ট লাইন’।
বাংলাদেশ অঞ্চলে ভূমিকম্পের অন্যতম উৎস হলো ডাউকি ফল্ট, যেটি শেরপুর থেকে শুরু জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে বিস্তৃত।
আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, ‘এসব কারণে বাংলাদেশ খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই ভূমিকম্প অনুভব করার জন্য যে নিজের দেশেই উৎপত্তি হতে হবে, এমন না। এর প্রমাণ তো এবার পাওয়াই গেল। ৬১৮ কিলোমিটার দূরের ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ভালোই ঝাঁকুনি খেয়েছে। মিয়ানমারের ৫ মাত্রার ভূমিকম্পও ঢাকার মানুষ টের পাচ্ছে। ওইসব এলাকার বড় ভূমিকম্প আমাদের জন্য হুমকির।’
তার মতে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, ভারত, নেপালের অবস্থান ওই তিন ফল্ট লাইনের আশেপাশে।
তিনি বলেন, ‘তাই, মিয়ানমারের পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প আমরা অনুভব করি। আর যদি সেখানে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তখন আমাদের ওপর সেই প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর ভারত বা নেপালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ওই সম্ভাবনা আরও বেশি।’
যদিও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাখাওয়াত হোসেনের মতে, ‘আমাদের দেশ জাপানের মতো ভূমিকম্প প্রবণ না। আমরা মডারেটলি ভূমিকম্প প্রবণ দেশ। কিন্তু সেই অনুযায়ী আমাদের তো প্রস্তুতি নাই। আমাদের বিল্ডিং কোড মানা হয় না।’
কীভাবে ভূমিকম্প পরিমাপ করা হয়?
মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল নামেও ভূমিকম্প পরিমাপ করার একটি স্কেল আছে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র হিসেবে পরিচিত রিখটার স্কেলকে প্রতিস্থাপন করেছে।
ভূমিকম্পের মাত্রা বোঝাতে যে সংখ্যাটি দেওয়া হয়, তা দিয়ে ফল্ট লাইন কতটুকু সরেছে এবং যে গতি এই সরানোর পেছনে কাজ করেছে সেটি নির্দেশ করে।
২ দশমিক ৫ বা তার কম কম্পন সাধারণত অনুভূত হয় না, তবে যন্ত্রে ধরা পড়ে। ৫ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয় এতে সামান্য ক্ষতি হতে পারে। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প বেশ শক্তিশালী বলে ধরা হয় এবং এতে মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হয়।
৮ মাত্রার বেশি কোনো ভূমিকম্প যে কোনো কিছুর ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে এবং এর কেন্দ্রে থাকা অবকাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে।
দুটি টেকটোনিক প্লেট বা সাবপ্লেট পরস্পরের দিকে অগ্রসর হলে একটি আরেকটির নিচে প্রবেশ করে। সাধারণত ভারি পাতটি হালকা পাতের নিচে প্রবেশ করে এবং যে সীমানা বরাবর প্রবেশ করে তাকে সাবডাকশন জোন বলে।
বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন, সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দু'টো ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর।
সূত্র: বিবিসি বাংলা