সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুয়া খবর (ফেইক নিউজ) এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডার (পেইড প্রোপাগান্ডা) দৌরাত্ম্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সাইবার সাক্ষরতা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ, সেখানে আবেগতাড়িত মিথ্যা তথ্য জনমতকে প্রভাবিত করে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
সঠিক তথ্য চিনে নেওয়া এবং ভুয়া কনটেন্ট প্রত্যাখ্যান করা এখন প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি অপরিহার্য দক্ষতা। নিচে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেইক নিউজ ও পেইড প্রোপাগান্ডা শনাক্ত করার ১৩টি কার্যকর উপায় পয়েন্ট আকারে দেওয়া হলো—
১. উৎস যাচাই করা (সোর্স ভেরিফিকেশন)
নাম না-জানা পেজ/প্রোফাইল: যেকোনো পোস্ট নাম না-জানা বা সন্দেহজনক পেজ/প্রোফাইল থেকে এলে প্রথমেই সেটিকে সন্দেহের চোখে দেখুন।
পরিচিত সংবাদমাধ্যম যাচাই: পরিচিত সংবাদমাধ্যম (যেমন: বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো অথবা যমুনা টেলিভিশন ইত্যাদি) থেকে এলে লিংকে ক্লিক করে মূল সাইটে গিয়ে তথ্যটি মিলিয়ে নিন।
ফেইক পেজ শনাক্তকরণ: ইচ্ছাকৃতভাবে বানানো ফেইক পেজ, যেমন ‘Som0y Tv’ (সংখ্যা ব্যবহার) বা ‘BBc Bangla নিউজ’ (অতিরিক্ত অক্ষর বা বানান ভুল) বহুল প্রচলিত। বানান ও লোগো ভালো করে দেখুন।
২. হেডলাইন দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন না
বাংলাদেশের ফেইক নিউজের ৮০ শতাংশ কেবল উত্তেজক, ক্লিকবেট শিরোনাম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করে।
পুরো কনটেন্ট না দেখে ভুলেও শেয়ার বা বিশ্বাস করবেন না।
অতিরঞ্জিত শব্দ যেমন ‘ভয়াবহ’, ‘অবশেষে সত্য প্রকাশ পেল’, ‘ব্রেকিং নিউজ’ এগুলো সাধারণত ভুয়া বা পক্ষপাতমূলক কনটেন্টে ব্যবহৃত হয়।
৩. ছবি বা ভিডিওর সত্যতা যাচাই
পুরোনো কনটেন্ট: পুরোনো ভিডিও বা ছবিকে নতুন ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি রাজনৈতিক বা পুরোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভিডিও প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়।
রিভার্স ইমেজ সার্চ: ছবি কোথা থেকে এসেছে তা যাচাই করতে গুগলের Reverse Image Search (image.google.com) ব্যবহার করুন।
ভিডিও বিশ্লেষণ: ভিডিওর লোগো (ওয়াটারমার্ক), ব্যাকগ্রাউন্ডের ভাষা, পোশাকের ধরন এসব দেখে অনুমান করুন দেশ বা সময়ের সঙ্গে ঘটনাটির কোনো মিল আছে কি না।
৪. মন্তব্য ও শেয়ার সংখ্যা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন না
বট অ্যাকাউন্ট: বাংলাদেশে রাজনৈতিক কনটেন্টে হাজারো বট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার হওয়া খুব সাধারণ।
সন্দেহজনক প্রোফাইল: একই ধরনের প্রোফাইল ছবি, ২০২৪-এ খোলা নতুন অ্যাকাউন্ট, এবং প্রোফাইলে কোনো পোস্ট নেই এমন অ্যাকাউন্ট থেকে আসা শেয়ার বা মন্তব্য সন্দেহজনক।
অনেক বেশি শেয়ার মানেই সত্য এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
৫. ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন
নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম: বিডি ফ্যাক্ট চেক, বুম বাংলাদেশ, এএফপি ফ্যাক্ট চেক বাংলা–এসব সাইটে প্রচুর ভুয়া তথ্য খণ্ডন করা হয়।
কোনো ছবি বা দাবি সন্দেহজনক মনে হলে তাদের সার্চ বক্সে খুঁজে দেখুন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আগেই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।
৬. পেইড প্রোপাগান্ডা সনাক্ত করুন
‘Sponsored’ ট্যাগ: পোস্টে যদি ‘Sponsored’ বা ‘Promoted’ লেখা থাকে, তবে বুঝবেন অর্থ দিয়ে প্রচার করা হয়েছে এটি পেইড প্রোপাগান্ডা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট: একপাক্ষিক রাজনৈতিক প্রশংসা বা গালাগালি-ভিত্তিক কনটেন্ট এগুলো সাধারণত একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়ানো প্রোপাগান্ডা।
ন্যারেটিভ তৈরি: বারবার একই ন্যারেটিভ ছড়ানোর জন্য ১০–২০টা পেজ একসঙ্গে একই ধরনের পোস্ট করে থাকে।
৭. অতি আবেগপ্রবণ কনটেন্টকে সন্দেহ করুন
আবেগের ফাঁদ: রাগ, ভয়, ঘৃণা যে আবেগগুলো আপনাকে চট করে শেয়ার করতে প্রলুব্ধ করে এসব কনটেন্টই সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বা উদ্দেশ্যমূলক হয়।
মনস্তাত্ত্বিক কৌশল: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে আবেগকেন্দ্রিক কনটেন্ট দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা একটি অত্যন্ত সাধারণ কৌশল।
৮. তথ্য মিলিয়ে নেওয়া (ক্রস-চেক)
একাধিক উৎস: যেকোনো দাবি যেমন ‘নতুন আইন পাশ হয়েছে’, ‘কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে’, ‘ভূমিকম্প আসছে’ কমপক্ষে একাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস দেখে মিলিয়ে নিন।
সরকারি ঘোষণা: সরকারি ঘোষণার সত্যতা জানতে সরকারি ওয়েবসাইট, পিআইডি (প্রেস ইনফোরমেশন ডিপার্টমেন্ট), বা পুলিশের ভেরিফায়েড পেজ যাচাই করুন।
৯. ভেরিফায়েড ব্যাজ মানেই সত্য নয়
টাকায় কেনা ব্যাজ: নীল ব্যাজ এখন টাকা দিয়ে কেনা যায়, ফলে বাংলাদেশে বহু ভুয়া পেজও ভেরিফায়েড দেখানো হয়।
পেজ হিস্টোরি: প্রোফাইলের আগের নাম, পুরোনো পোস্টগুলো দেখে নিশ্চিত হোন পেজ নাম ও উদ্দেশ্য বদল করে ভেরিফায়েড পেজকে ভুয়া কাজে ব্যবহার করার ঘটনাও আছে।
১০. নিজের ডিজিটাল জ্ঞান বাড়ান
বয়োজ্যেষ্ঠদের সহায়তা: বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যবহারকারীদের জন্য সহজ টিপস শিখিয়ে দিন, যেমন– শিরোনাম দেখে না-শেয়ার করা, সন্দেহ হলে সন্তান/পরিবারকে জিজ্ঞেস করা, সরকারি তথ্য সবসময় অফিসিয়াল সাইটে মিলিয়ে নেওয়া।
সাইবার সাক্ষরতা: বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সাইবার সাক্ষরতা এখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা।
১১. ব্যক্তিগত গোপন তথ্য কখনো শেয়ার করবেন না
ফিশিং লিংক: ভুয়া নিউজ বা প্রোপাগান্ডার সঙ্গে থাকে লোভনীয় লিংক যেমন– ‘ফ্রি সহায়তা’, ‘রেজিস্ট্রেশন’, ‘সরকারি অনুদান’ এগুলো ফিশিং লিংক হতে পারে।
জাতীয় পরিচয়পত্র, ওটিপি, পাসওয়ার্ড কোনো অবস্থাতেই কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
১২. বিতর্কিত ঘটনার ভিডিও প্রথম আপলোডকারীকে খুঁজুন
আসল উৎস: একটি ভিডিও শতবার শেয়ার হতে পারে, কিন্তু আসল উৎস একজনই।
প্রথম আপলোডকারীর প্রোফাইল দেখে অনেক সময় বোঝা যায় এটি উদ্দেশ্যমূলক (প্রোপাগান্ডা) নাকি স্বাভাবিক নাগরিক-তথ্য।
১৩. ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানো কনটেন্টকে ব্যতিক্রম নিয়মে সন্দেহ করুন
সংবেদনশীলতা: বাংলাদেশে ফেইক নিউজ সবচেয়ে বেশি ছড়ায় ধর্মীয় উত্তেজনা বা সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে।
সতর্কতা: এমন কনটেন্ট দেখলে প্রথমেই অতি সতর্ক হোন বেশিরভাগ সময়ই উদ্দেশ্য থাকে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই তথ্য-বিপ্লবের যুগে, মিথ্যা তথ্য এবং সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা মোকাবিলা করা কেবল ব্যক্তিগত সতর্কতা নয়, বরং একটি সামাজিক এবং বৈশ্বিক দায়িত্ব। কেবলমাত্র উৎস যাচাই, ছবি ও ডেটা বিশ্লেষণ এবং আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে ফেইক নিউজের জাল পুরোপুরি ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব না তবে রোধ ও বিস্তার কমানো সম্ভব।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সত্য ও মিথ্যা তথ্যের সীমারেখা এখন এতটাই অস্পষ্ট যে, প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে সচেতনভাবে একজন ফ্যাক্ট-চেকার এবং দায়িত্বশীল ডিজিটাল নাগরিকের ভূমিকা নিতে হবে। এই করণীয়গুলো আমাদের জন্য একটি ঢালস্বরূপ যা আমাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও সামাজিক শান্তি রক্ষায় অপরিহার্য। আসুন, আমরা সম্মিলিতভাবে ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করি এবং অনলাইন মাধ্যমকে ভীতির বদলে তথ্যের আস্থাশীল উৎস হিসেবে গড়ে তুলি।
লেখক: শামস্ সোহাগ, লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব