আপডেট :
১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২:২৯:৩২
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বাংলাদেশের সাবেক সরকারপ্রধানদের মধ্যে তিনিই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হলেন।
শেখ হাসিনা ছাড়াও বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন সময় অন্তত ৪৭ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ইতিহাস, রাজনীতি ও ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত সবার রায় কার্যকর হয়নি। অনেকে রায় ঘোষণার আগে দেশ থেকে পালিয়েছেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের আবার সাজাও কমেছে। এ-যাবৎ বিভিন্ন পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ৩৫ জনের।
শেখ হাসিনার রায় ছাড়াও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই ঘটনাগুলোর সারসংক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো-
১. জুলফিকার আলী ভুট্টো
জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নওয়াব মোহাম্মদ আহমদ খানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লাহোর হাইকোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। তবে পাকিস্তানে এই ঘটনা ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ হিসেবে বিবেচিত, যা পরবর্তীকালে দেশটির সুপ্রিম কোর্টও ‘বিচারিক ব্যর্থতা’ বলে ঘোষণা করে।
২. নিকোলাই চসেস্কু
নিকোলাই চসেস্কু ছিলেন রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৭ সাল থেকে স্টেট কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এরপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৯ সাল সময়ে ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। তার এ দীর্ঘ শাসনামলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমে তিনি নাগরিকের অধিকার সীমিত, রাজনৈতিক বিরোধ দমন করেন। গোপন পুলিশের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক দমন-নিপীড়ন চালিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত চসেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনা চসেস্কুকে গ্রেপ্তার করা হয়। দ্রুত পরিচালিত পিপলস ট্রাইব্যুনালে চসেস্কু অর্থনৈতিক অন্তর্ঘাত ও গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। বিচার শেষে ১৯৮৯ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
চসেস্কুর আগে আরেক রোমানিয়ান সরকারপ্রধান ইয়ন আন্তোনেস্কুও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার শাসনকালে রোমানিয়া জার্মান নাৎসি জোটের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখেছিল। রোমানিয়ায় বসবাসরত ইহুদি ও রোমা জনগণকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ১৯৪৫ সালে রোমানিয়ান পিপলস ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ১৯৪৬ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
৩. বেনিতো মুসোলিনি
কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯২২-১৯৪৩ সময় পর্যন্ত। মিত্রশক্তির অগ্রযাত্রায় একসময় দেশ থেকে পালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল গুলি চালিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
৪. আইভান বাগরিয়ানো
আইভান বাগরিয়ানোভ ছিলেন বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৪ সালে এ দায়িত্ব পালনকালে নাৎসি জোটের পক্ষাবলম্বনের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তাকে পিপলস ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন আইভান। ১৯৪৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বহু বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশটির আদালত আইভানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রত্যাহার করেন।
৫. দোব্রি বোঝিলোভ
দোব্রি বোঝিলোভ ছিলেন বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তার দণ্ডাদেশও ১৯৯৬ সালে আদালত প্রত্যাহার করেন।
৬. বগদান ফিলভ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বগদান ফিলভ ছিলেন বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী (১৯৪০-৪৩)। তিনি নাৎসি জার্মানির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে সোভিয়েতপন্থী জনতার আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারিতে রায় কার্যকর হয়। অবশ্য ১৯৯৬ সালে তার এ রায়ও প্রত্যাহার করে নেন দেশটির আদালত।
৭. সেলাল বায়ার
সেলাল বায়ার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। এর আগে তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কার্যকলাপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৬১ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে সাজা হ্রাস করা হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি মুক্তি পান।
৮. শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর আমলে আমির-আব্বাস হোভেইদা
শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর আমলে আমির-আব্বাস হোভেইদা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ইরানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি শাহের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের পর তাকে দুর্নীতি ও শাহের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। বিপ্লব-পরবর্তী আদালতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
৯. সাদ্দাম হোসেন
সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয় একজন শাসক ছিলেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। পরে তাকে ইরাকি বিশেষ আদালতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচার শেষে ২০০৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১০. মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ
মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সালে। তালেবান অভ্যুত্থানের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১১. ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস
১৬৪৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং পার্লামেন্টের সঙ্গে বিরোধের জেরে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তার এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাজা প্রথম চার্লসের মৃত্যুদণ্ড ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পরিণতি এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়, যা আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
১২. ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই
১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি, ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে প্যারিসের রিভোল্যুশনারি ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজতান্ত্রিক শাসন এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে গিলোটিনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ঘটনা বিপ্লবীদের জয়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের পতনের সূচনা করে।
প্রাচীন আমল থেকে আধুনিক যুগে এমন আরও অনেক সম্রাট, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বিভিন্ন অপরাধে কিংবা কখনো রাজনৈতিক বিবাদে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে আধুনিক সময়ে পাওয়া যায়- এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট গেরার্দো বারিওস (১৮৫৯-৬৫), রুশ জার (১৮৯৪-১৯১৭) দ্বিতীয় নিকোলাস, চীনের জাতীয় সরকার কমিটির চেয়ারম্যান (১৯৪৪-৪৫) চেন গংবো, চীনে জাপানি দখলদারদের সহযোগী সরকারের চেয়ারম্যান (১৯৩৮-৪০) লিয়াং হোংঝি, সেন্ট্রাল আমেরিকান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট (১৮৩০-৩৯) ফ্রান্সিসকো মোরাজান, ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান (১৯৭৭-৯১) মেংগিস্টু হাইলে মারিয়াম, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৩-৫৫) ইম্রে নাগি, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫০-৬০) অ্যাডনান মেন্দেরেস, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট (১৮৭০-৭১) এডওয়ার্ড জেমস রয়, কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা (২০০১-১৯), স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট (১৯৩৯-৪৫) যোজেফ টিসো, জাপানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৪১-৪৪) হিদেকি তোজো, হাঙ্গেরির সরকারপ্রধান (১৯৪৪-৪৫) ফেরেঞ্চ সালাশি, পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট (২০০১-০৮) পারভেজ মোশাররফ, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট (১৯৬৭-৭৩) জর্জিও পাপাডোপুলোস, দাহোমের (বর্তমানে বেনিন) প্রেসিডেন্ট (১৯৬৮-৬৯) এমিল ডারলিন জিনসু, মালির প্রেসিডেন্ট (১৯৬৮-৯১) মুসা ট্রাওর, ভিচি ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধান (১৯৪০-৪৪) ফিলিপ পেতাঁন, কঙ্গো‑ব্রাজাভিলের রাষ্ট্রপ্রধান (১৯৬৩-৬৮) আলফনসে মাসাম্বা-দেবাটের নাম।
এছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগে অনেক শাসকও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন- চীনের কিন রাজবংশের শাসক লি সি, ২০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আরও আছেন চীনের জিন রাজবংশের শাসক সিমা চি ও সিমা ইয়ে। এদের শাসকাল ছিল ৩০৭ থেকে ৩১৬ খ্রিস্টাব্দ। আছে কিন রাজবংশের ইং জিয়িং ও ঝাও গাও এবং সঙ রাজবংশের সম্রাট ঝাও জিয়ান। সং রাজবংশের ওয়েন তিয়ানঝিয়াং দ্বাদশ শতাব্দীতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।