আপডেট :
০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১:০০:৫৬
খাগড়াছড়ি দাবড়ে বেড়াচ্ছেন নারী বাইকাররা। গণপরিবহনের চেয়ে ঝামেলা কম, সাশ্রয়ী ও আরাম দায়ক হওয়ায় খাগড়াছড়িতে নারীদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে স্কুটি। কলেজ পড়ুয়া ও কর্মজীবী নারীদের পছন্দের বাহনের তালিকায় বেশ আগেই জায়গা করে নিয়েছে দুই চাকার বাহন স্কুটি। শখে নয়, প্রয়োজনের তাগিদেই পাহাড়ের নারীরা বেছে নিচ্ছেন এ বাহন। ফলে দিন দিন বাড়ছে নারী বাইকারের সংখ্যাও।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ের নারীদের জীবনে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে এনজিওগুলোর তৎপরতা। দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বড় একটি জায়গাজুড়ে স্থান করে নেন শিক্ষিত নারীরা।
কিন্তু মাঠে-অফিসে, অংশীজনের দুয়ারে, প্রশাসনিক কাজে শহরে হোক আর তৃণমূলে স্থানীয় সরকারে– যেখানেই যাবেন, পথ তো বন্ধুর। পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান প্রায় পুরোটাই সুউচ্চ পাহাড়, রাঙামাটির অধিকাংশ পানিপথ আর খাগড়াছড়ি হলো পাহাড়ের মাঝে মাঝে সমতল জনপথ।
চলাচলের সুবিধার্থে এই খাগড়াছড়িতেই সবার আগে নারীরা পথে নামান নিজের বাহন স্কুটি। এখন শুধু বাইক হাঁকিয়ে স্বচ্ছন্দে পথচলা নয়, নিজেদের মধ্যে দারুণ যুথবদ্ধতাও তৈরি হয়েছে নারীদের। দুটি অনলাইন গ্রুপ গড়ে তোলে দূরদূরান্তে ভ্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমও পরিচালনা করছেন তারা।
খাগড়াছড়িতে কলেজ পড়ুয়া, চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী নারীদের পছন্দের বাহনের তালিকায় বেশ আগেই জায়গা করে নিয়েছে দুই চাকার বাহন স্কুটি। আজকাল খাগড়াছড়ি জেলা জুড়ে প্রায়ই চোখে পড়ে নারীদের স্কুটি চালিয়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়ার দৃশ্য। শখে নয়, প্রয়োজনের তাগিদেই পাহাড়ের নারীরা বেছে নিচ্ছেন এ বাহন। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপটও। এতে উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়াতে কাজ করছে ‘কেজিসি লেডি বাইকারস’।
সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন নারী স্কুটি চালকরা তারপরও সব বাঁধা পেরিয়ে পাহাড়ের নারীরা বাইকেই পথ চলতে চান।
এখন খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দামের দুইশরও বেশি স্কুটির চাকা ঘোরাচ্ছেন নারীরা। জাতীয় নারী ফুটবলের সাবেক সদস্য আনুচিং মারমাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মোটরসাইকেলও ব্যবহার করেন। আনুচিং বলেন, ‘দেশে-বিদেশে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছি। তাই সাহস করেই মোটরসাইকেল চালাই। প্রথম দিকে মানুষজন আড়চোখে তাকালেও এখন আর কিছু বলে না।’
খাগড়াছড়ির হোন্ডা মোটরসাইকেলের শোরুমের মালিক মো. ইসমাইল জানান, তিনি গত পাঁচ বছরে রাঙামাটি আর খাগড়াছড়িতে কমপক্ষে ১০০টি লেডি বাইক বিক্রি করেছেন। এখনও মাসে গড়ে কমপক্ষে তিনটি বাইক বিক্রি করছেন।
টিভিএস শোরুমের মালিক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ২০১৮ সাল থেকে লেডি বাইক বা স্কুটির বাজার খাগড়াছড়িতে বাড়তে থাকে। এখন জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। আমরা মাসে গড়ে চার-পাঁচটি লেডিস বাইক বিক্রি করি।
ইতিমধ্যে খাগড়াছড়িতে নারী বাইকারদের দুটি সংগঠনও গড়ে উঠেছে। এরই একটি কেজিসি লেডি বাইকার গ্রুপের অ্যাডমিন নুর আয়েশা বেগম জানান, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতসহ বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া ও দৈনন্দিন কাজের জন্য নারীকে গণপরিবহনে যেতে হলে অনেক সময় নষ্ট হয়। নিজের বাহনে সময় ও অর্থ এবং শ্রম দুটোই সাশ্রয় হয়।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় খাগড়াছড়ি ফিমেল রাইডারস গ্রুপ। এটির অ্যাডমিন হেলি চাকমা জানান, ৩০-৪০ জন সদস্য আছেন এই গ্রুপে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজও করা হয় এ গ্রুপের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষ এখনো কোনো নারীকে দুই চাকার যানের চালকের আসনে ভাবতে বা দেখতে ঠিক অভ্যস্ত নন। পরিবারের সম্মতিটা প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বড় সাহসের ব্যাপার হিসেবে কাজ করে। সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারলে স্কুটি হবে নারীর জন্য নিজের বৈশিষ্ট্য ও স্বয়ম্ভরতা প্রকাশের বড় এবং বলিষ্ঠ মাধ্যম। আজ আমি স্কুটি চালাতে পারি বলে কর্মস্থল যেতে পারি স্বাধীনভাবে। আগে আমার স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হতো।
খাগড়াছড়ি বিআরটিএর সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মো. মুছা জানান, ২০২৪ সালে তার অফিস থেকে ৫৬ জন নারী ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ২৪ জন নারী বাইকের রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন।
২০১৪ সাল থেকে খাগড়াছড়িতে হিরো মোটরসাইকেলের শোরুম পরিচালনা করছেন সুদর্শন দত্ত। তিনি খাগড়াছড়ি চেম্বারেরও পরিচালক। তিনি জানান, খাগড়াছড়ি জেলাতে সড়ক নেটওয়ার্ক অন্য দুই পার্বত্য জেলার চেয়ে অনেক বেশি। এখানে প্রতিনিয়ত নারী বাইকারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অর্থনীতিতেও এটির একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
খাগড়াছড়ির নবাগত জেলা প্রশাসক আনোয়ার সাদাত জানান, সমতলে জীবনের গতির সঙ্গে বাইকের একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এখন পাহাড়েও নারীর বাইকযাত্রার গল্প বড় হচ্ছে। নারীর এই অগ্রযাত্রায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষে সৃজনশীল কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা, তা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ঠিক করা হবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ বলেন, নারীদের সুরক্ষায় পুলিশ প্রশাসনের সু নজর রয়েছে। বাইক চালাতে গিয়ে কোন নারী যাতে হয়রানি বা লাঞ্চনার শিকার না হয় সে ব্যাপারেও পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।
জানা যায়, খাগড়াছড়িতে প্রায় ২০০ জন নারী স্কুটি বাইক ব্যবহার করছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা নারী স্কুটি চালকদের।