উত্তর থেকে দক্ষিণ, পানি বন্দি জনপদ; দুর্ভোগে কোটি মানুষ
প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৫, ১:২২:৪১
উত্তর থেকে দক্ষিণ, পানি বন্দি জনপদ; দুর্ভোগে কোটি মানুষ
ঢাকা, বিশেষ প্রতিনিধি
২০২৫ সাল যেন হয়ে উঠেছে বন্যার নতুন নামান্তর। এপ্রিলের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া লাগাতার বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদ। এবারকার বন্যা শুধু বিস্তৃতিই নয়, তীব্রতাতেও ছাড়িয়ে গেছে গত কয়েক বছরের রেকর্ড। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল বাংলাদেশ যেন একযোগে পানির নিচে।
বৃষ্টির রেকর্ডে চমক, প্রস্তুতিহীনতাই বিপদের মূল?
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মে মাসেই গড়ে ৪৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের মেঘালয় ও আসাম অঞ্চল থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবেই এবার সময়ের আগেই এবং অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে।জলবায়ু গবেষক ড. সাকলাইন আহমেদ বলেন:“আগে যেখানে জুন-জুলাইয়ে বন্যা আসত, এবার মে মাসেই ভয়াবহ অবস্থা। বাংলাদেশ এখন আর মৌসুমি বন্যার দেশ নয় এখন এটা হয়ে উঠছে ‘চিরবন্যার দেশ’।”
পানি বন্দি মানুষের হাহাকার: কোথাও খাদ্য সংকট, কোথাও আশ্রয়ের
“তিন দিন হলো চালের মুখ দেখিনি” বলছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাসিন্দা হাসিনা বেগম।
“নদী পাড়ের ঘরটা চলে গেছে। এখন ত্রাণ চাইতে চাইতে লজ্জা লাগে,” বললেন সিরাজগঞ্জের বানভাসি জাহিদুল ইসলাম।
সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ২৭টি জেলার ১৪০টি উপজেলার ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
সরকারি পদক্ষেপ ও প্রস্তুতির অভাব
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বানভাসি এলাকায় ২ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ত্রাণ হিসেবে পাঠানো হয়েছে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ।
তবে বাস্তব চিত্র বলছে ত্রাণের পরিমাণ অপর্যাপ্ত, অনেক জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না সঠিকভাবে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে একজন এনজিও কর্মী জানান: “ত্রাণের তালিকায় নাম তোলার জন্যও চাপ আছে। অনেকেই বাদ পড়ছে। একাধিক পরিবার এখনও রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে।”
পিছিয়ে পড়ছে কৃষি ও শিক্ষাও
উত্তরাঞ্চলে ধান কাটার মৌসুম চলছিল, বন্যা এসে তা পণ্ড করে দিয়েছে। পাশাপাশি, বহু স্কুল ভবন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় শিক্ষায়ও স্থবিরতা এসেছে।
কৃষি অফিস বলছে, প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে খাদ্য মজুদের ওপরও।
বন্যা পূর্বাভাস ও আগামী দিনের শঙ্কা
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও এফএও বলছে, আগামী এক সপ্তাহেও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। জুনের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দ্বিতীয় দফার বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন বন্যা ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, বন্যার পূর্বাভাস আরও নিখুঁত করা, এবং ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
শুধু বন্যা নয়, অব্যবস্থাপনাও এক দুর্যোগ
২০২৫ সালের বন্যা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল প্রকৃতির দুর্যোগের সঙ্গে আমরা কতটা অপ্রস্তুত। জলবায়ু সংকটের এই যুগে শুধু পানি নয়, আমাদের নীতিনির্ধারণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি, এবং নাগরিক দায়িত্বের অভাবই বিপদকে গহ্বরে টেনে নিচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে এই দুর্যোগের পরও কি আমরা ঘুম থেকে জাগব?