নীতিমালার ঘাটতি ও করপোরেট সংস্কৃতিতে সমতা নেই
প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৩৪:০৫
স্নাতক উত্তীর্ণ, কিন্তু ঘরেই বসে: ঢাকার এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন খাদিজা রহমান। ফলাফলে ফার্স্ট ক্লাস, ইংরেজি ও ডিজিটাল স্কিলে সাবলীল। অথচ এখন তিনি পুরোদস্তুর গৃহিণী। “চাকরি করতে চাই, কিন্তু পরিবার চায় না। তাছাড়া বাইরে গেলে ‘বউমা কী কাজ করবে’ এ নিয়েও ফিসফাস চলে।” বলেন খাদিজা।এই গল্প শুধু খাদিজার না। বাংলাদেশে হাজার হাজার শিক্ষিত নারী প্রতিবছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছেন না।
নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের চমকপ্রদ অগ্রগতি
বিগত এক দশকে বাংলাদেশ নারী শিক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য এক নজির স্থাপন করেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতায় নারীরা শক্ত অবস্থানে
সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে
ইউনেসকোর (২০২3) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন নারী শিক্ষার হার ৭২ শতাংশের কাছাকাছি, যা পাকিস্তান ও ভারতের চেয়েও বেশি।
তবু কেন পিছিয়ে কর্মসংস্থানে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়:
১৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ মাত্র ৩৮.৬%
যেখানে পুরুষদের অংশগ্রহণ ৮১.৭%
নগরে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ হার আরও কম
অর্থাৎ শিক্ষা আছে, কিন্তু কর্মসংস্থানে নারীদের অবস্থান ভয়াবহভাবে পিছিয়ে।
মূল বাধাগুলো কী কী?
১. পারিবারিক ও সামাজিক মানসিকতা: মেয়েদের শুধু শিক্ষিত হওয়া দরকার, চাকরি করা নয় এমন দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিবারেই রয়ে গেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের পর নারীর ক্যারিয়ার থেমে যায়।
২. কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ও হয়রানি: নারী কর্মীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের অভাব এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা।
যাতায়াত সমস্যা
অফিসে যৌন হয়রানি
মাতৃত্বকালীন ছুটির পর চাকরি হারানো
৩. কাজের ধরনে বৈষম্য ও বেতন কাঠামো: নারী-পুরুষ সমকাজে সমবেতন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক সময় নারী কর্মীদের মাইনর রোলেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
৪. চাইল্ড কেয়ার ও পরিবার সামলানোর দ্বৈত চাপে নারী পিছিয়ে পড়ে: একদিকে অফিস, অন্যদিকে সংসার এই দ্বৈত বোঝা অনেক সময় নারীদের চাকরি থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।
শুধু শিক্ষা নয়, সমতার পরিবেশ জরুরি
নারী অধিকার বিষয়ে কাজ করা অধ্যাপক ড. ফারহানা ইসলাম বলেন “নারীদের চাকরিতে প্রবেশের পথ যতটা কঠিন, তার চেয়েও কঠিন চাকরিতে টিকে থাকা। শিক্ষিত নারীদের জন্য স্বতন্ত্র নীতি, পরিবার-সহযোগিতা ও অফিস সংস্কৃতির রূপান্তর ছাড়া এগোনো যাবে না।”
আইনি কাঠামো ও নীতির দুর্বলতা
নারী উন্নয়ন নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন এখনো অনেকখানি কাগুজে।
সরকারি চাকরিতে কোটা আছে, কিন্তু করপোরেট জগতে নেই
প্রাইভেট অফিসে ডে-কেয়ার, মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই
কর্মঘণ্টা নারীবান্ধব নয়
কিছু আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ
কয়েকটি বড় করপোরেট হাউসে নারী বান্ধব নীতি চালু হয়েছে
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে অনেক নারী ঘরে বসেই উপার্জন শুরু করেছেন
কী করা জরুরি?
1. শিক্ষা শেষে নারীদের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং
2. জব প্লেসমেন্ট ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে নারীদের অগ্রাধিকার
3. প্রতিটি কর্মস্থলে ডে-কেয়ার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
4. চাকরিজীবী মায়েদের জন্য ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার্স
5. পারিবারিক ও সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তনে মিডিয়াভিত্তিক সচেতনতা
শুধুমাত্র শিক্ষিত নারী নয়, কর্মক্ষম নারী চাই
বাংলাদেশে নারী শিক্ষার যে সাফল্য, সেটি নিঃসন্দেহে গর্বের। কিন্তু এই শিক্ষা যদি সমাজ-অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে রূপ না নেয়, তাহলে তা পূর্ণতা পায় না।কারণ, শিক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল হওয়া উচিত স্বাবলম্বিতা ও সম্মানজনক জীবন।এখন সময় শিক্ষিত নারীদের চাকরির বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার। এই দায়িত্ব কেবল নারীদের নয়, আমাদের সবার।