দরপত্রে সুবিধাবাদী সংশোধনী, রাজনীতিসংশ্লিষ্ট প্রেস মালিকদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব স্পষ্ট
প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২৫, ১১:৫৫:০৭
২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও পুনরাবৃত্তির শঙ্কা, দরপত্র সংশোধনে চক্রের চাপ: এনসিটিবি ইতোমধ্যে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ১,৬০০ কোটি টাকা বাজেটের আওতায় নতুন পাঠ্যবই ছাপার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার জন্য প্রাথমিকভাবে ২২.৭৫ ও ৩৩.৫ ইঞ্চি আকারের ওয়েব মেশিন ব্যবহারের শর্ত দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হলেও, পরে তা সংশোধন করে ২২ ও ৩২ ইঞ্চিতে নামিয়ে আনা হয়। কাগজ ছাপার এই সীমিত মাপ শিক্ষাবিষয়ক কারিগরি মানদণ্ড অনুযায়ী অপ্রতুল এবং নিম্নমান নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে। একাধিক প্রেস মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ১১৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সংশোধনীর পক্ষে চিঠি দেয়। বিশাল অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দরপত্রের প্রযুক্তিগত মানদণ্ড বদলে দিতে এনসিটিবিকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়।
রাজনৈতিক প্রভাবে আগ্রাসী প্রেস মালিকদের প্রভাব, বইয়ের গুণগত মানে ভয়াবহ সংকট: ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব পাওয়া আনন্দ প্রিন্টার্স-এর মালিক রব্বানি জব্বার সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ একজন পূর্ণমন্ত্রীপুত্র ও উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রেসে ছাপা ২০ হাজার বই এনসিটিবি কর্তৃক বাতিল করা হয়। অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনও বই ছাপার প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী। তদ্ব্যতীত, তিনি এখনো বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সভাপতির পদ ছাড়েননি, যা প্রভাব খাটানোর একটি বড় প্ল্যাটফর্মে রূপ নিয়েছে। পরিদর্শনে ধরা পড়েছে ১৩ কোটি বই নিম্নমানের, কাগজের জিএসএম কমিয়ে বিপুল লোপাট। এনসিটিবি ৩২টি পরিদর্শন দল পাঠিয়ে দেশের ৬৪ জেলা থেকে পাঠ্যবই নমুনা সংগ্রহ করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪০ কোটির মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি বইয়ে জিএসএম, ঔজ্জ্বল্য, ছাপা ও বাঁধাইয়ে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে, বহু প্রতিষ্ঠান চুক্তিতে নির্ধারিত কাগজের মান (জিএসএম) না মেনে বই ছেপেছে। লেটার এন কালার লিমিটেড ৮০ জিএসএমের বদলে ৬৯ ও ৭০ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করেছে, যা সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের বলে চিহ্নিত হয়েছে। অনুপম প্রিন্টার্স ৭০ জিএসএমের বদলে দিয়েছে ৬১ জিএসএম, আর অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৮০ জিএসএমের স্থলে দিয়েছে মাত্র ৭৩ জিএসএম। এছাড়া, দ্য গুডলাক ৮০ জিএসএমের স্থলে ৭১ জিএসএম, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৭০-এর পরিবর্তে ৫৯, সুবর্ণা প্রিন্টার্স ৭০-এর জায়গায় ৫৫ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করেছে। অ্যারিস্টোক্র্যাটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং, বর্ণমালা প্রেস, ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, দোয়েল প্রিন্টার্স এবং রেদওয়ানিয়া প্রেস সবকটিই নির্ধারিত মানের চেয়ে নিচু মানের কাগজ সরবরাহ করেছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জিএসএম ছিল ৫৫–৬৫-এর মধ্যে, যেখানে চুক্তি অনুযায়ী ৭০–৮০ জিএসএম দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন অনিয়মের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে বই ‘রিপ্লেস’ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লেটার এন কালার লিমিটেডের মালিক শেখ সিরাজউদ্দিন স্বীকার করেছেন যে, কিছু বইয়ে জিএসএম কম ছিল এবং এনসিটিবির চিঠি পাওয়ার পর তারা বই রিপ্লেস করছেন। চিঠি ইস্যু, শাস্তিমূলক পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, “১৬টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদি তারা বই রিপ্লেস না করে, তাহলে তাদের পারফরম্যান্স মানি কেটে নেওয়া হবে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।”
সুশাসনের ঘাটতি ও ভবিষ্যতের শিক্ষা ঝুঁকিতে: বিশ্লেষকদের মতে, পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। দুর্নীতিবাজ চক্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞানভিত্তি দুর্বল করে দেবে। শিক্ষাবিদ ড. কামরুল আহসান বলেন, “পাঠ্যবই শুধু একখানা বই নয়, এটি হলো ছাত্রের ভিত্তি নির্মাণের উপকরণ। নিম্নমানের বই মানে নিম্নমানের ভবিষ্যৎ।” ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ঘিরে ঘটে যাওয়া অনিয়ম, ঘুষ ও দুর্নীতি কেবল একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত নয় এটি শিশু শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের ঘাটতির প্রতিফলন। ২০২৬ সালের প্রাক্কালে সেই একই চক্র, একই ছাঁদে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মূল প্রতিরোধ হওয়া উচিত ছিল এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এখন প্রশ্ন হলো এই দুর্নীতি থামাতে কে এগিয়ে আসবে?