প্রকাশিত :
২০ জুলাই ২০২৫, ৭:১০:৩১
এক সময় শহুরে রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন রাজধানী ঢাকার সীমানা পেরিয়ে ভয়ংকর রূপে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামীণ জনপদে। শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের অন্তত ১০টি জেলার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। বরিশাল বিভাগের এক জেলা বরগুনাতেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের চেয়েও বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৩৯৫ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৮৫৬ জন, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৮০ শতাংশ। অথচ রাজধানীর সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা ও হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৩ হাজার ৫৩৯ জন রোগীই রাজধানীতে চিকিৎসা নিয়েছেন।
উপেক্ষিত গ্রামাঞ্চলের প্রস্তুতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব ও স্থানীয় হাসপাতালগুলোর অপ্রতুল অবকাঠামো। বেশিরভাগ উপজেলা হাসপাতালে শয্যা সংকট, মশা নিয়ন্ত্রণে সামান্য জনবল ও অত্যন্ত কম বাজেটেই মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন সংক্রামক ব্যাধি। এতে করে পরিস্থিতি দিন দিন আরো জটিল হচ্ছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা শহর কেন্দ্রীক যুদ্ধ করেছি, অথচ কোনো সুফল আসেনি। এখন যদি গ্রামাঞ্চলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর দেশের মানুষকে ডেঙ্গুর ছোবল সহ্য করতে হবে।”
পরিসংখ্যানে বিপদের আভাস
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ডেঙ্গুর বিস্তার এখন ঢাকাকেন্দ্রিক নয়। ২০২১ সালে যেখানে রাজধানীতে মোট আক্রান্তের ৮৩ শতাংশ ছিল, ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৩ শতাংশে। বরং ২০২৩ সালেই প্রথমবার ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৬ শতাংশে পৌঁছায়। চলতি বছর সেই সংখ্যা আবারও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ৪৪ শতাংশে।
বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক। বরগুনা জেলায় রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৯৫৭ জন, যা দেশের একক কোনো জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু বরিশাল বিভাগেই ৬ হাজার ৬৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
চার জেলা ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’, ভয়াবহ লার্ভা উপস্থিতি
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ, মাগুরা, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী পৌর এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে বেশি। জরিপে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি পাওয়া গেছে ঝিনাইদহ পৌর এলাকায়, যেখানে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ (বিআই) ৬০ শতাংশ। মাগুরায় তা ৫৫ দশমিক ৫৬, পিরোজপুরে ২০ এবং পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।
এ ছাড়া বাসাবাড়িতে লার্ভার উপস্থিতির (হাউজ ইনডেক্স) হিসেবে বরগুনার গ্রামাঞ্চলে লার্ভার হার ৭৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি।
গভীর বিপদের বার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চিত্র শুধু এক বছরের জন্য হুঁশিয়ারি নয়—এটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সংকটের পূর্বাভাস। ডেঙ্গু এখন আর শুধু একটি শহুরে মৌসুমি রোগ নয়, বরং এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। অবিলম্বে জেলা ও উপজেলাভিত্তিক আলাদা কর্মপরিকল্পনা, সচেতনতা, জরুরি বাজেট বরাদ্দ এবং জনবল বাড়ানোর দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।