প্রকাশিত :
২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১:৩৩:০৯
আমরা শ্বাস নিই, হৃদস্পন্দন চলে, চোখের পাতা পলক ফেলে, খাবার গিলে ফেলি এসব কাজের জন্য আলাদা করে ভাবতে হয় না। অথচ এই ভাবনা ছাড়াই চলা জীবনযাত্রার পেছনে রয়েছে মস্তিষ্কের এক ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী অংশ ‘মস্তিষ্ককাণ্ড’ বা ‘ব্রেইনস্টেম’। আকারে ছোট হলেও আমাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো নীরবে সামলে নেয় এই অংশটি।
ব্রেইনস্টেম হলো মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের সংযোগস্থল। এটি মস্তিষ্কের নিচের দিকে, খুলির পেছনের অংশে অবস্থিত। শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, ঘুম-জাগরণ যেসব কাজ আমাদের শরীর নিজে নিজেই করে, সেগুলোর মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হলো এই মস্তিষ্ককাণ্ড। ব্রেইনস্টেম আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অংশ এবং এটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, যেগুলো একসঙ্গে কাজ করে শরীরকে সচল ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখে।
ব্রেইনস্টেমের কাজ
ব্রেইনস্টেম শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে মস্তিষ্কের বার্তা আদান-প্রদান করে। এটি মূলত অনৈচ্ছিক বা স্বয়ংক্রিয় কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন—
১. শ্বাস-প্রশ্বাস
২. হৃদ্স্পন্দন ও রক্তচাপ
৩. শরীরের ভারসাম্য ও মুখের নড়াচড়া
৪. শ্রবণশক্তি
৫. গিলতে পারা
৬. স্বাদ অনুভব
৭. ঘুম ও জাগরণের ছন্দ
এই কাজগুলো করতে আমাদের আলাদা করে চিন্তা করতে হয় না সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ককাণ্ডের মাধ্যমে।
ব্রেইনস্টেম রিফ্লেক্স
ব্রেইনস্টেম রিফ্লেক্স হলো এমন কিছু তাৎক্ষণিক ও স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া, যা আমাদের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো আমরা সচেতনভাবে করি না, বরং মস্তিষ্ককাণ্ড নিজে থেকেই শরীরকে নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে রয়েছে—
১. কার্ডিওভাসকুলার রিফ্লেক্স: হৃদ্স্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
২. গ্যাগ রিফ্লেক্স: শ্বাসনালি রক্ষা করে
৩. গিলন রিফ্লেক্স: খাবার ও তরল পাকস্থলীতে পৌঁছাতে সাহায্য করে
৪. পিউপিলারি লাইট রিফ্লেক্স: আলো অনুযায়ী চোখের মণির আকার পরিবর্তন
৫. ভেস্টিবুলো-অকুলার রিফ্লেক্স: মাথা নড়লেও চোখ স্থির রাখতে সাহায্য করে
৬. শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত রিফ্লেক্স: কাশি, হাঁচি ও শ্বাস নিয়ন্ত্রণ
ব্রেইনস্টেমের গঠন
ব্রেইনস্টেম তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত—
১. মিডব্রেন- মস্তিষ্ককাণ্ডের উপরের অংশ। চোখের নড়াচড়া, চলন নিয়ন্ত্রণ এবং দেখা-শোনার তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ভূমিকা রাখে।
২. পন্স- মাঝের অংশ। মুখ ও চোখের নড়াচড়া, মুখের অনুভূতি, শ্রবণশক্তি এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. মেডুলা অবলংগাটা- সবচেয়ে নিচের অংশ। শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও গিলনক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেএ
এছাড়া মস্তিষ্ককাণ্ডে রয়েছে রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিস্টেম (আরএএস) যা আমাদের জেগে থাকা, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা এবং ঘুম-জাগরণের চক্র নিয়ন্ত্রণ করে।
ব্রেইনস্টেম কখন ক্ষতিগ্রস্থ হয়
ব্রেইনস্টেম থেকে ১২টির মধ্যে ১০টি ক্রেনিয়াল নার্ভ উৎপন্ন হয় (৩ থেকে ১২ নম্বর নার্ভ)। এগুলো আমাদের নড়াচড়া, অনুভূতি, স্বাদ ও শ্রবণশক্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নানান ধরনের রোগ ও আঘাতে মস্তিষ্ককাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেমন—
১. স্ট্রোক
২. ব্রেইন টিউমার
৩. রক্ত জমাট বাঁধা
৪. এনসেফালাইটিস
৫. হৃদরোগ বা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট
৬. ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি (টিবিআই)
ব্রেইনস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেসব সমস্যা দেখা দেয়: ব্রেইনস্টেম গুরুতর আঘাত বা অন্যান্য কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হতে পারে
২. হৃদ্স্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে
৩. চলাফেরায় সমস্যা বা পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে
৪. কোমায় চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে
এ ধরনের অবস্থা জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতি। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে জীবনসংকট তৈরি হতে পারে। যখন ব্রেইনস্টেম স্থায়ীভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন তাকে বলা হয় ব্রেইনস্টেম ডেথ বা মস্তিষ্ক-মৃত্যু। এ অবস্থায় মানুষ আর জ্ঞান ফিরে পায় না এবং কৃত্রিম লাইফ সাপোর্ট ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শ্বাস নেওয়া, হৃদ্স্পন্দন চলা, ভারসাম্য বজায় রাখা বা ঘুম থেকে জেগে ওঠা এসবের কোনোটাই আমরা সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করি না। তবু প্রতিটি মুহূর্তে এগুলো নির্ভুলভাবে পরিচালিত হয় ব্রেইনস্টেমের মাধ্যমে। এটি সুস্থ থাকলে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে চলে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুহূর্তেই জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই ব্রেইনস্টেম কোনও উপসর্গকে কখনোই হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। দ্রুত চিকিৎসা ও সঠিক যত্ন অনেক ক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে পারে এবং সুস্থতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
সূত্র: ক্লিভল্যানড ক্লিনিক