প্রকাশিত : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১২:০৯
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ সোমবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর কিছুক্ষণ পর কয়েকটি ওয়েবসাইটে খবর প্রকাশিত হয়, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১০০১ জন শিক্ষক’। ‘বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দ’ নাম ব্যবহার করে বিবৃতিটি মিডিয়ায় পাঠানো হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্ৰদীপ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০১ জন স্বাক্ষর করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও মোট ৬৫৯ জন শিক্ষকের নাম যুক্ত করা হয়েছে। তবে অনেক শিক্ষকের নাম অজান্তে ব্যবহার করা হয়েছে বলে ডিজিটাল ইনভেস্টিগেটিভ মিডিয়া আউটলেট দ্য ডিসেন্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীর ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে রায় ঘোষণা করেছে তা প্রহসনমূলক ও অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বর্তমানে ক্যাঙারু কোর্টের রূপ পরিগ্রহ করেছে এর স্বৈরাচারী, পক্ষপাতদুষ্ট এবং ন্যায়বিচার পরিপন্থী কার্যকলাপ তথা মিথ্যা সাক্ষাৎ প্রামাণের মাধ্যমে।’
‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এ দেশের কোটি জনতা আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ ধরনের বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রমূলক এবং পূর্বনির্ধারিত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি এবং ক্যাঙারু কোর্টের প্রহসনমূলক রায়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’
দ্য ডিসেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্ৰদীপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে মোবাইলে পাওয়া যায়নি। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মরজিনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি জানান, মাহবুব আলম প্রদীপ দীর্ঘদিন ধরে ছুটিতে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন।
এদিকে বিবৃতিতে নাম রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ১৫ জন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবৃতির বিষয়ে জানতে চায় দ্য ডিসেন্ট। তাদের সবাই বলেছেন তারা এই বিবৃতির বিষয়ে কিছুই জানেন না।
যাদের সঙ্গে দ্য ডিসেন্ট যোগাযোগ করেছে তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নঈম উদ্দিন হাসান আওরঙ্গজেব, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ, সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ কাফি প্রমুখ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেছেন, ‘আমি এই বিবৃতির কিছুই জানি না। অন্য কোনো শিক্ষক এ ধরণের বিবৃতি দিয়েছেন বলেও আমার জানা নেই। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র বলেই আমি মনে করছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘'আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করেনি কিছু। বিনা অনুমতিতে এভাবে কারো নাম দেওয়া তো ঠিক না।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক নঈম উদ্দিন হাসান আওরঙ্গজেব এই প্রতিবেদক থেকে প্রথম এ ব্যাপার জানলেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমি তো এমনকিছু জানিই না। কারা দিয়েছে এসব? কখন?’
সংবাদটি সর্বপ্রথম প্রকাশ করে বায়ান্ননিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টাল। তারা কীভাবে বা কোথায় পেয়েছে বিবৃতি তা জানতে পোর্টালটির সম্পাদক ও প্রকাশক বিভাষ বাড়ৈর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য ডিসেন্ট।
তিনি বলেন, ‘'এটা শিক্ষক সংগঠনগুলো থেকেই আসছে। দুপুর সোয়া ৩ টার দিকে ৩/৪ জায়গা থেকে আসছে। আমরা প্রথম আপলোড দিছিলাম। পরে দেখলাম এটা নিয়ে আপত্তি আছে তাই সরাই দিছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ সাদী বলেন, ‘বিবৃতিটি দেখে বিস্মিত হলাম যে, ওখানে নাকি আমার নামও রয়েছে। কিন্তু আমি এর কিছুই জানি না। কে বা কারা এই তালিকা প্রস্তুত করেছে আমার সম্মতি ছাড়া, আলাপা ছাড়া আমার নাম ব্যবহার করেছে, এর সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, নেইও।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিবৃতিতে আমিসহ আরও অনেক শিক্ষকের নাম তাদের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে। আমি মনে করি, কারো অনুমতি ছাড়া তাদের নাম ব্যবহার করা, তা-ও এ ধরনের একটি সেনসিটিভ ইস্যুতে, এটি অবশ্যই একটি ফৌজদারি অপরাধ, কোনো সাধারণ অপরাধ না। যে এই কাজটা করেছেন, তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
বেশ কয়েকজন শিক্ষক ইতোমধ্যে ফেসবুকে নিজেদের প্রোফাইলে পোস্ট করে এই বিবৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই বলেও জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার সাইদ লিখেছেন, ‘কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষকদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি বিবৃতি ভাইরাল হয়েছে। এই বিবৃতিতে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই তালিকায় আমার নাম সংযুক্ত করায় প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
ইতহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম তার ফেসবুক আইডিতে লিখেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম সংবলিত বিবৃতিতে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আমাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের জানামতে আমরা এই ধরনের কোনো বিবৃতিতে স্বাক্ষর বা কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করিনি। বিষয়টি আমাদের হতাশ করেছে। উল্লেখ্য যে সব ধরনের অতীতের নোংরা ও কলুষিত রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ফজলুল হালিম তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমার কর্মস্থল। আমি আমার কর্মস্থলে কোনো প্রকার শিক্ষক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নই। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একটি বিবৃতি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেখানে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আমি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছি যে আমার কোনো অনুমতি বা সম্মতি ছাড়াই এই বিবৃতিতে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বিবৃতিটির বিষয়ে আমাকে অবহিতও করা হয়নি। কাজেই উক্ত বিবৃতিতে আমার নাম অন্তর্ভুক্তকরণ সম্পূর্ণ অননুমোদিত। এ বিষয়ে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীদের বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।