প্রকাশিত :
২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১:২১:২৭
ইসলামে জীবিতদের মতো মৃতদেরও সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। কোনো মুসলমান মারা গেলে তার মাগফিরাত বা ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে যে বিশেষ নামাজ আদায় করা হয়, তাকে জানাজার নামাজ বলে। এটি জীবিতদের ওপর মৃত ব্যক্তির অধিকার এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘ফরজে কিফায়া’। অর্থাৎ সমাজের কিছু মানুষ আদায় করলেই সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। তবে সওয়াব ও মৃত ব্যক্তির উপকারের কথা বিবেচনা করে সঠিক নিয়মে ও শুদ্ধ দোয়ায় জানাজা পড়া অত্যন্ত জরুরি। নিচে জানাজার নামাজের নিয়ত, নিয়ম ও দোয়াগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
জানাজার নামাজের নিয়ত ইসলামের যেকোনো ইবাদতের মূল ভিত্তি হলো নিয়ত। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।’ (সহিহ বুখারি: ১)
নিয়ত শব্দের অর্থ মনের দৃঢ় সংকল্প। জানাজার নামাজের জন্য অন্তরে এই ইচ্ছা থাকাই যথেষ্ট যে, ‘আমি এই ইমামের পেছনে জানাজার নামাজ আদায় করছি’। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো আরবি বাক্য বা গৎবাঁধা বাংলা বুলি আওড়ানোর প্রয়োজন নেই। এমনকি জানাজায় উপস্থিত লাশটি পুরুষ নাকি নারী, শিশু নাকি বয়স্ক তা নির্দিষ্ট করে না জানলেও নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে ইমাম বা দায়িত্বশীলদের উচিত নামাজের আগে মরদেহের পরিচয় (পুরুষ/নারী/শিশু) স্পষ্ট করা, যাতে মুসল্লিরা তৃতীয় তাকবিরের পর সঠিক দোয়াটি পড়তে পারেন।
কেউ যদি মনের ইচ্ছার পাশাপাশি মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করতে চান, তবে তা বিদআত হবে না। সেক্ষেত্রে সহজ বাংলায় এভাবে বলা যেতে পারে, ‘আমি চার তাকবিরের সঙ্গে এই ইমামের পেছনে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে জানাজার নামাজ আদায়ের নিয়ত করছি, আল্লাহু আকবার।’
জানাজার নামাজের ফরজ ও সুন্নত জানাজার নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এর ফরজ ও সুন্নতগুলো জানা জরুরি।
ফরজসমূহ
১. চারটি তাকবির বলা। ২. দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা (ওজর ছাড়া বসে পড়া জায়েজ নেই)।
সুন্নতসমূহ
১. প্রথম তাকবিরের পর সানা পড়া। ২. দ্বিতীয় তাকবিরের পর দরুদ শরিফ পড়া। ৩. তৃতীয় তাকবিরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট দোয়া পড়া।
জানাজার নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম ও দোয়া জানাজার নামাজে কোনো রুকু বা সিজদা নেই। ইমামের সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কান পর্যন্ত দুই হাত উঠিয়ে অন্যান্য নামাজের মতো হাত বাঁধতে হবে। এরপর নিচের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে:
১. প্রথম তাকবিরের পর (সানা) ইমামের সাথে প্রথম তাকবির বলে হাত বাঁধার পর নিচু স্বরে সানা পড়তে হয়:
আরবি: سُبْحَانَكَ اَللَّهُمَّ وَ بِحَمْدِكَ وَ تَبَارَكَ اسْمُكَ وَ تَعَالِىْ جَدُّكَ وَ لَا اِلَهَ غَيْرُكَ উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারাকাসমুকা, ওয়া তাআলা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা। অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনার নাম অতি বরকতময়। আপনি সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
২. দ্বিতীয় তাকবিরের পর (দরুদ শরিফ) এরপর ইমাম দ্বিতীয় তাকবির বলবেন। এই তাকবিরে হাত ওঠানো যাবে না, হাত বাঁধা অবস্থাতেই থাকবে। দ্বিতীয় তাকবিরের পর নামাজে পঠিত দরুদ ইব্রাহিম পড়া সুন্নত:
আরবি: اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম-মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ কামা বারাকতা আলা ইবরাহিম ওয়া আলা আলি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম-মাজিদ। অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি নবী মুহাম্মাদ ও তার বংশধরের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমনভাবে রহমত বর্ষণ করেছিলেন ইবরাহিম (আ.) ও তার বংশধরের ওপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত।
৩. তৃতীয় তাকবিরের পর (মৃতের জন্য দোয়া) ইমাম তৃতীয় তাকবির বলার পর (হাত না উঠিয়ে) মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে হয়। মৃত ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিচের দোয়াটি পড়তে হবে:
আরবি: اَللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِ نَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَنَا اَللّٰهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلٰى الْاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلٰى الْاِيْمَانِ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা-গফিরলি হায়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াহতাহু মিন্না ফাআহয়িহী আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াত্তফাহু আলাল ইমান। অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড় এবং পুরুষ ও নারী সবাইকে ক্ষমা করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাদের জীবিত রেখেছেন ইসলামের ওপর জীবিত রাখুন আর যাদের মৃত্যুদান করেছেন তাদের ইমানের সঙ্গেই মৃত্যুদান করুন।
মৃত ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে: যদি মৃত ব্যক্তি নাবালক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়, তবে তৃতীয় তাকবিরের পর এই দোয়াটি পড়তে হবে:
আরবি: اَللّٰهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وَّاجْعَلْهُ لَنَا اَجْرًا وَّذُخْرًا وَّاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَّمُشَفَّعًا উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা-জআলহু লানা ফারতাও ওয়া-জআলহু লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়া-জআলহু লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফাআন। অর্থ: হে আল্লাহ! তাকে আমাদের অগ্রবর্তী ব্যবস্থাপক (যে আগে গিয়ে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করে) বানিয়ে দিন। তাকে আমাদের জন্য পরকালের সঞ্চয় ও সওয়াবের উপকরণ বানিয়ে দিন এবং তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী ও গ্রহণযোগ্য সুপারিশকারী বানান।
৪. চতুর্থ তাকবির ও সমাপ্তি তৃতীয় তাকবিরের দোয়া শেষ হলে ইমাম চতুর্থ তাকবির বলবেন। এই তাকবিরের পর আর কোনো দোয়া নেই। হাত না উঠিয়েই ইমামের সাথে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে।
হাত বাঁধা ও ছাড়ার নিয়ম জানাজার নামাজে কেবল প্রথম তাকবিরের সময় কান পর্যন্ত হাত উঠাতে হয়। বাকি তিনটি তাকবিরে হাত ওঠানোর প্রয়োজন নেই। হাত ছাড়ার বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন চতুর্থ তাকবিরের পরপরই হাত ছেড়ে দিতে হবে, আবার কেউ বলেন দুই দিকে সালাম ফেরানোর পর হাত ছাড়তে হবে। দুটি মতই শুদ্ধ, তাই সুবিধামতো যেকোনো একটি অনুসরণ করা যায়।