ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তৎপর অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব পাচ্ছে মানবাধিকার, জবাবদিহি ও অপারেশনাল নীতি।
প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১:৩৬:২২
বাংলাদেশ পুলিশের মূল দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। কিন্তু যুগের পর যুগ এই বাহিনীকে জনগণের সেবক না হয়ে বরং শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের নৃশংস দমন-পীড়ন, নির্বিচারে গুলি এবং সহিংসতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি কমিশনটি ৩৫৫ পৃষ্ঠার বিস্তারিত রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয়।
প্রতিবেদনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি হয়।
১১টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত:
১. থানায় জিডি, এফআইআর, তদন্ত ও ভেরিফিকেশন
২. আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদে স্বচ্ছতা
৩. বেআইনি সমাবেশে বলপ্রয়োগে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মডেল অনুসরণ
৪. মানবাধিকার রক্ষা
৫. বিশেষায়িত ইউনিট শক্তিশালীকরণ
৬. নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে নীতিগত পরিবর্তন
৭. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন
৮. যুগোপযোগী আইন ও প্রবিধানমালা প্রণয়ন
৯. প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক বাহিনী গঠন
১০. ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন
১১. বিবিধ পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি
বৈঠকে জানানো হয়, পুলিশের কাছে থাকা লিথাল অস্ত্র (যেমন শটগান, রাবার বুলেট, তীব্র টিয়ার গ্যাস ইত্যাদি) ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে প্রযুক্তি-নির্ভর ‘নন-লিথাল’ পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলপ্রয়োগ নীতিমালা অনুসরণে প্রশিক্ষণও চালু হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, "আমাদের কাজ ছিল সুপারিশ তৈরি করা। এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের।"
কমিশনের আরেক সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, “এই কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সব পক্ষ একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে একমত হয়েছে। এই কমিশন থাকলে ভবিষ্যতে সরকার পুলিশকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লিথাল উইপন প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘ মডেল অনুসরণে প্রশিক্ষণ শুরু এ দুটি পদক্ষেপ বাস্তব পুলিশ সংস্কারের দিকেই যাচ্ছে। তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কতোটা নিরপেক্ষ ও ধারাবাহিক হবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক জবাবদিহির ওপর।