আপডেট :
১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৯:০১:০৮
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। বহু বিক্ষোভকারীর কাছে এটা স্বস্তির খবর। তবু নয়াদিল্লিতে নির্বাসিত অবস্থায় থাকা এই ৭৮ বছর বয়সি নেত্রীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত দূরবর্তীই বলে মনে হচ্ছে। কারণ ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন এমন এক উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা নয়াদিল্লির জন্য শুধু রাজনৈতিকভাবে কঠিন নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেরও পরিপন্থী।
নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শিমা আক্তার যখন জানতে পারেন হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তার কাছে এটি ন্যায়বিচারের প্রথম সোপান মনে হচ্ছিল। গত বছরের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নে তার বেশ কয়েকজন বন্ধু নিহত হন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভেবেছিলেন তিনি চিরকাল ক্ষমতায় থাকবেন। মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রতীক।’ তবে শুধু রায় নয়—ঢাকায় ফাঁসিতে ঝোলানো দেখে তবেই ন্যায়বিচার পূর্ণ হবে বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তব থেকে অনেক দূরে। ২০২৪ সালের আগস্টে বিক্ষোভকারীরা তার বাসভবনে হামলা চালালে হাসিনা রাজধানী থেকে পালিয়ে ভারতের নতুন দিল্লিতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। অভ্যুত্থানের পর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কেরও অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। এখন মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর উত্তেজনা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত হাসিনার পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাইলেও এমন কোনো পরিস্থিতি কল্পনাযোগ্য নয় যেখানে নয়াদিল্লি তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করতে ঢাকায় ফেরত পাঠাবে। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী স্পষ্টভাবে বলেন, ‘নয়াদিল্লি তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে, এটা কল্পনাই করা যায় না।’
হাসিনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে তিনি পরবর্তী ১৫ বছর শাসন করেন। যদিও সেই সময়টিতে বিরোধী দলগুলোর ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দমন-পীড়নের অভিযোগ ব্যাপকভাবে উঠে আসে। একই সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে সামনে রেখে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের শাসনকে সফল হিসেবে তুলে ধরেন।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন সহিংস দমন-পীড়নের মুখে পড়ে দেশব্যাপী হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সংঘর্ষে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন । মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে ইউনূস সরকারের পাকিস্তানঘনিষ্ঠ অবস্থান এবং ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে অস্থিতিশীল করেছে।
বাংলাদেশ দাবি করছে বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে হাসিনাকে ফেরত পাঠাতেই হবে। কিন্তু ভারতের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি অভিযোগ ‘রাজনৈতিক চরিত্রের’ হয়, তবে ফেরত নাও পাঠানো যেতে পারে। নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজের মতে, ভারত ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তির রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে। তিনি মনে করেন, হাসিনাকে হস্তান্তর করা মানে হবে বর্তমান বিরোধী শক্তিকে ভারতের পক্ষ থেকে বৈধতা দেওয়া—যা নয়াদিল্লি করতে চাইবে না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা রায়টি লক্ষ্য করেছে এবং বাংলাদেশের সকল পক্ষের সাথে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে দুই দেশের সম্পর্কে এখন অবিশ্বাসই বড় বাধা। চক্রবর্তী বলেন, ‘বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের পর নতুন সরকার এলেই সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে।’ তিনি মনে করেন, ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করা উচিত নয়।
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘ভারত হাসিনাকে নিয়ে দ্বিধায় থাকলেও জনরোষের বাস্তবতা বুঝতে পারছে। তবু ঐতিহাসিক কারণে ভারত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল এবং ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলালে দলটি আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।’ দত্তের মতে, ভারতকে এখন বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।’
হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পেছনে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫ সালে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হওয়ার পর হাসিনা প্রথমবার ভারতের আশ্রয় পান। সে সম্পর্ক আজও নয়াদিল্লির নীতিগত অবস্থানকে প্রভাবিত করছে। ভারতীয় বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ভারতকে তার মিত্রের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সুযোগ দিয়েছে। আর দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ভারতের জন্য লাভজনক হতে পারে।’
সব মিলিয়ে বিশ্লেষকদের মতে, ভারত নিজের কৌশলগত স্বার্থ, নৈতিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য বিবেচনা করেই হাসিনাকে বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করতে চায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট দুই দেশের সম্পর্কে একটি স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।