আপডেট :
২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯:৪৫:৫৪
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক ধ্রুবতারার নাম মুস্তাফিজুর রহমান। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার পর থেকেই নিজের বিষাক্ত কাটারে বিশ্বজুড়ে ব্যাটারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছেন তিনি। কেবল জাতীয় দল নয়, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া আসর আইপিএলেও তিনি এখন বাংলাদেশের সবথেকে সফল প্রতিনিধি। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্যে মিশে আছে এক ভাইয়ের ত্যাগ আর এক কিশোরের অদম্য জেদের গল্প।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের এক নিভৃত পল্লী থেকে বিশ্বজয়ের পথে মুস্তাফিজের এই অভিযাত্রা হার মানায় রূপকথাকেও। যে ছেলেটি একসময় ব্যাট হাতে বাইশ গজে ঝড় তোলার স্বপ্ন দেখতেন, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ‘হীরার খনি’ অর্থাৎ বোলিং প্রতিভাকে প্রথম চিনেছিলেন স্থানীয় এক কোচ। তবে এই স্বপ্নকে ডানা মেলার সুযোগ করে দিতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন মুস্তাফিজের মেজ ভাই মোখলেসুর রহমান।
প্রতিদিন কাকভোরে যখন পুরো গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত, তখন ভাইকে বাইকের পেছনে বসিয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরা সদরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন তিনি। মেজ ভাইয়ের সেই অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিজের অদম্য জেদ সঙ্গী করে ২০১২ সালে পকেটে সামান্য কিছু টাকা আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অচেনা শহর ঢাকায় পা রাখেন মুস্তাফিজ। আজ ৯ কোটি ২০ লাখ টাকার আইপিএল চুক্তিতে যখন তার নাম উচ্চারিত হয়, তখন আসলে সেই মেজ ভাইয়ের বাইকের চাকা আর সাতক্ষীরার মাটিরই জয় হয়।
বিসিবির পেস ফাউন্ডেশনে ট্রায়াল দেওয়ার সময় তার বোলিংয়ের অস্বাভাবিক গতি আর কবজির অদ্ভূত মোচড় দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন নির্বাচকরা। অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের প্রতিটি ধাপে নিজের জাত চিনিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালের এক পড়ন্ত বিকেলে মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে যখন কিংবদন্তি মাশরাফি বিন মোর্তুজার হাত থেকে জাতীয় দলের অভিষেক ক্যাপটি গ্রহণ করছিলেন, তখন মুস্তাফিজের চোখে ছিল জল আর হৃদয়ে ছিল গোটা বাংলাদেশের ভার। পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ আমিরের ভক্ত মুস্তাফিজের মূল শক্তি হলো তার অকৃত্রিম সারল্য আর আঙুলের ডগায় লুকানো সেই মারণঘাতী স্লোয়ার ও কাটার।
মুস্তাফিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান:
- ওডিআই: ১১৪ ইনিংসে ১৭৭ উইকেট (অভিষেক সিরিজে ভারতের বিপক্ষে ১১ উইকেট)।
- টি-টোয়েন্টি: ১২৫ ইনিংসে ১৫৮ উইকেট।
- টেস্ট: ২৫ ইনিংসে ৩১ উইকেট।
মুস্তাফিজের আইপিএল যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হাত ধরে। অভিষেক ম্যাচেই ক্রিস গেইল, বিরাট কোহলি এবং এবি ডি ভিলিয়ার্সদের বিপক্ষে তিনি ছিলেন অদম্য। সে আসরে ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে হায়দরাবাদকে শিরোপা জেতান তিনি এবং ভারতের বাইরে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন।
পরবর্তীকালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, রাজস্থান রয়্যালস ও দিল্লি ক্যাপিটালসের পর ২০২৪ সালে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে তার প্রত্যাবর্তন ছিল দুর্দান্ত। অভিষেক ম্যাচেই ৪ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়া ফিজ ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট শিকার করেন। বর্তমানে তিনি আইপিএল ইতিহাসের সবথেকে দামী বাংলাদেশি ক্রিকেটার। ২০২৫ সালের মেগা নিলামে তীব্র লড়াই শেষে ৯ কোটি ২০ লক্ষ রুপিতে তাকে কিনে নিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর)। আইপিএলে এ পর্যন্ত ৬০ ম্যাচে তার ঝুলিতে আছে ৬৯টি উইকেট।
জাতীয় দল এবং আইপিএল ছাড়াও বর্তমানে তিনি আইএলটি-২০ (আইএলটি২০)-সহ বিভিন্ন বিশ্বসেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নিয়মিত খেলছেন। সাতক্ষীরার সেই লাজুক কিশোরটি আজ কেবল বাংলাদেশের সম্পদ নন, বরং বিশ্ব ক্রিকেটের এক দামী ব্র্যান্ড। তার প্রতিটি কাটার যেন সেই মেজ ভাইয়ের বাইকের চাকার গতির প্রতিচ্ছবি, যা আজও বাইশ গজে ব্যাটসম্যানদের পরাস্ত করে চলেছে।